প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাতক্ষীরার ভোমরা শুল্ক স্টেশনটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে চলেছে। বিগত ২০১৯-২০২০ থেকে ২০২৩ -২০২৪ পাঁচটি অর্থ বছরে ভোমরা শুল্ক স্টেশন থেকে সরকারের ৩৬২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এছাড়া চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৬৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। সম্প্রতি গুড়া দুধ ছাড়া বাকি সব ধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এই বন্দরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে প্রত্যাশা বন্দর সংশ্লিষ্টদের।
ভোমরা ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, বিগত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৫৮৩.৪০ কোটি টাকা, ২০২০-২০২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৭৬০.৬৫ কোটি টাকা, ২০২১ -২০২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৭৪১.৮৩ কোটি টাকা, ২০২২ -২০২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৬৩১.৭২ কোটি টাকা এবং ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৯০৭.৫৭ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে-জুলাই সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৬৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
সূত্র আরও জানায়, ডিজিটাল ওয়েবীজ স্কেলে পরিমাপ করায় রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ হওয়ায় সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে বেড়েছে সরকারের রাজস্ব আদায়। ফলে গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ৭৩.৪৮ কোটি টাকা। সম্প্রতি ভোমরা বন্দর দিয়ে গুড়োদুধ ছাড়া সকল ধরনের পণ্যের আমদানির অনুমোদন পাওয়ায় এ বন্দরে আসতে শুরু করেছেন অন্য বন্দরের ব্যবসায়িরা। সব ধরনের পণ্য আমদানির কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করলে এই বন্দর থেকে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে বলে দাবি কাস্টম কর্তৃপক্ষের।
ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা বলেন, ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিন দাবির মুখে গত ২৯ আগস্ট বেনাপোল বন্দরের ন্যায় ভোমরা বন্দরে গুড়া দুধ ব্যতিত আমদানিকৃত সকল পণ্যের অনুমতি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দরের বিপরীতে ভারতে ঘোজাডাঙ্গা কাস্টমস থেকে কলকতার দূরত্ব মাত্র ৭০ কিলোমিটার হওয়ায় পণ্য পরিবহনে খরচ সাশ্রয় করতে আমদানি-রপ্তানিকারকরা এই বন্দর ব্যবহারে বেশি আগ্রহী। সব ধরনের পন্য আমদানির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় ব্যবসায়িরা এখন ভোমরা বন্দরের দিকে বেশি ঝুকছেন।
ভোমরা স্থলবন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু হাসান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে কাস্টমস প্রশাসন। কোনো অনিয়ম দুর্নীতি করার সুযোগ না থাকায় এখানে তৈরি হয়েছে ব্যবসাবান্ধব অনুকূল পরিবেশ। ভোমরা বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার পর এই বন্দরের রাজাস্ব আদায় বেড়ে যাবে কয়েক গুন। কর্মসংস্থার হবে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের।
ভোমরা ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশনের ডেপুটি কমিশনার মোঃ আবুল কালাম আজাদ জানান, শুরুতেই পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এই বন্দরে কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু চলতি বছরের ২৯ আগস্ট ভোমরা বন্দর দিয়ে গুড়ো দুধ ব্যতিত সকল পণ্য আমদানির অনুমতি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। ফলে সব ধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় ক্রমান্বয়ে রাজাস্ব আদায়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেনাপোল স্থলবন্দরের পরেই সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের অবস্থান। বর্তমানে দিনে গড়ে ২০০ থেকে ২৫০টি ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাকের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য, আবশ্যকীয় পণ্য ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পণ্য আমদানি হয়ে থাকে এ বন্দর দিয়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ১০০ পণ্যবাহী ট্রাকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। পূর্নাঙ্গ কাস্টমস হাউজ চালু হওয়ার পর ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভোমরা বন্দরে রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ করতে ডিজিটাল ওয়েবীজ স্কেলে পণ্য পরিমাপ করা হয়। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই, ডিজিএফআই, শুল্ক গোয়েন্দাসহ বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে ফলের ট্রাকসহ সকল পণ্য পরিবহনের ওজন ডিজিটাল স্কেলের মাধ্যমে শতভাগ নিশ্চিত করা হয়। যে কারণ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণে আগের তুলনায় বেড়েছে।
ভোমরা স্থলবন্দরের উপপরিচালক মোঃ রুহুল আমিন (ট্রাফিক) বলেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ এপ্রিল ১৬টি পণ্য নিয়ে এলসি স্টেশন হিসেবে যাত্রা শুরু করে ভোমরা স্থলবন্দর। মাত্র ১৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে ইয়ার্ড ও ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড নির্মাণ করে ২০১৩ সালের মে মাসে পূর্ণাঙ্গভাবে ভোমরা স্থলবন্দরের কবার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে বন্দরের প্রশাসনিক ভবন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসনের জন্য একটি ডরমেটরি ভবন নির্মাণ করা হয়। সম্প্রতি ভোমরা বন্দর দিয়ে গুড়া দুধ ভ্যাতিত সব ধরনের পণ্য আমদানির অনুমোদন দেয় এনবিআর কর্তৃপক্ষ। ভোমরা স্থল শুল্ক স্টেশনটিকে একটি পূর্নাঙ্গ কাস্টমস হাউজ হিসাবে ঘোষনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একই সাথে শুল্ক বিভাগ কর্তৃক প্রয়োজনীয় অবখাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত ৪ জুলাই থেকে ভোমরা স্থলবন্দরে বন্দর-ই-পোর্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফলে ভোমরা স্থলবন্দরের যাবতীয় কার্যক্রম এখন ডিজিটাল অটোমেশন পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হচ্ছে। যেহেতু খুব শীঘ্রেই ভোমরা একটি পূর্ণাঙ্গ কাস্টমস হাউজ হিসাবে কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে সে লক্ষ্যে ভোমরা স্থল বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছেন।
উপপরিচালক মোঃ রুহুল আমিন বলেন, বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে ১১শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যে প্রায় ১০ একর জমি অধিগ্রহণ শেষে সেখানে বালু ভরাটের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বাকি ৫৭ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য সরেজমিনে যৌথ তালিকা (ফিল্ডবুক) প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। শীঘ্রেই অধিগ্রহণেরে কাজ শুরু হবে। জমি অধিগ্রহণ শেষ হলে সেখানে উন্নতমানের ওয়ার হাউজ, শেড, ইয়ার্ড, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, পর্কিং ইয়ার্ড, আর্ন্তজাতিকমানের প্যাসেঞ্জার টার্মিনালসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে এগুলো সম্পন্ন করা হলে ভোমরা স্থলবন্দরে আমুল পরিবর্তন আসবে। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে বন্দরে। একই সাথে বছরের কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে।
খুলনা গেজেট/এনএম