খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ কার্তিক, ১৪৩১ | ২২ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  খা‌লিশপু‌রের হা‌সিবুর হত্যায় ২১ জনের যাবজ্জীবন, খালাস ৫

‘মুজিববর্ষে মুজিবের এক সময়ের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা আজ বড়ই অবহেলিত’

একরামুল হোসেন লিপু, দিঘলিয়া

আলহাজ্ব অধ্যাপক খন্দকার গোলাম মোস্তফা। অবহেলিত এক নিবেদিতপ্রাণ মুজিব কর্মীর নাম। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা দিঘলিয়া উপজেলার সুগন্ধি গ্রামে। তিনি ছিলেন ৯ নং সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য লাভ করেছেন এবং ’৬৯ এর গণআন্দোলনের এবং ’৭০ এর নির্বাচনের সময় খুলনাঞ্চলে দলের বিভিন্ন কর্মসূচীতে এবং নির্বাচনী প্রচারণায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সভামঞ্চে একই সাথে অংশ নিয়েছেন।

১৯৬০ সালে তার বয়স যখন ১৫ বছর তখন তিনি সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র। উক্ত বিদ্যালয়ে তখন সাংগঠনিক কাজে এসেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডঃ এনায়েতুর রহমান ও মরহুম আব্দুল কুদ্দুস। তাদের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণাই তখন থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। এরপর ১৯৬১ সালে সরকারি বিএল কলেজে পড়াশোনা চলাকালীন সময় তিনি আইয়ুব বিরোধী প্রত্যেকটা ছাত্র আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রভাগে থাকতেন। ১৯৬৫ সাল তৎকালীন সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সরকারি বি এল কলেজ ছাত্রলীগ মনোনীত আলী-তারেক পানেল থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি বৃহত্তর দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি একই পদে থেকে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং খুলনাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একই মঞ্চে তার সহযোগী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত একটানা ৯ বছর তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি বৃহত্তর দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ছিলেন দিঘলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯৪/৯৫ সাল পর্যন্ত একটানা ১৩ বছর দিঘলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ১৯৮৩ সালে তিনি খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মনোনীত হন। তৎকালীন সময়ে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন খুলনার ফুলতলার এ্যাডঃ আকরাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন স ম বাবর আলী। সংগঠনের এসব দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তিনি বৃহত্তর দৌলতপুর থানার (দিঘলিয়া উপজেলা তৎকালীন দৌলতপুর থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল) বিভিন্ন এলাকায় সাইকেল চালিয়ে প্রত্যেকটি এলাকায় দলের সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং সংগঠনকে গতিশীল করার জন্য কাজ করেছেন। তার সঙ্গে বৃহত্তর দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর খান আব্দুর রশিদও সাইকেল চালিয়ে সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। এলাকায় বয়োজেষ্ঠদের কাছে তিনি এবং প্রফেসর খান আব্দুর রশিদের আওয়ামী লীগের দুই মানিকজোড় হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি আছে।

তৎকালীন সময়ে একই সংগে রাজনীতি করেছেন দিঘলিয়ার প্রফেসর খান আব্দুর রশিদ, সেনহাটীর আবুবকর সিদ্দিকী, আলাউদ্দিন মুন্সী, মরহুম মুক্তিযোদ্ধা নজীর আহন্মেদ, মরহুম মুক্তিযোদ্ধা গাজী আরিফুর রহমান, বারাকপুরের মরহুম মুক্তিযোদ্ধা গাজী গোলাম মোস্তফা, দৌলতপুরের মরহুম মতি কমিশনার, আড়ংঘাটার রুহুল আমীন, নয়াবাটির সিদ্দীক মুন্সী প্রমুখ।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর মেজর সিধু কর্তৃক তিনি এবং দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামের মরহুম মুক্তিযোদ্ধা শেখ নজির আহম্মেদ মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র প্রাপ্ত হন।

এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ১৯৬৪ সালে থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত একটানা ২৮ বছর দল করেছি। অনেক সময়, শ্রম এবং মেধা ব্যয় করেছি প্রিয় এই সংগঠের জন্য। কলেজ জীবনে যেখানে ছাত্ররা জীবনটাকে উপভোগ করে আর আমরা সেই সময়ে আউয়ূব বিরোধী উত্তাল আন্দোলনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের প্রত্যেকটা আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছি। আমাদের মতো নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের মেধা, শ্রম এবং ত্যাগের বিনিময়ে আজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। ২০০৮ সাল থেকে এখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। এই দীর্ঘ সময়ে দল আমাদের কিছুই দেয়নি, দলের কাছে কোনদিন কিছু দাবি করেনি। কিন্ত সবচেয়ে আশ্চর্য এবং দুঃখের বিষয় খুলনা জেলা, মহানগর আমার রাজনীতির বিচরন ক্ষেত্র দৌলতপুর থানা এবং দিঘলিয়া উপজেলার আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আমরা বড়ই অবহেলিত এবং অবমূল্যায়িত। সংগঠন কিংবা রাষ্ট্রীয় কোন অনুষ্ঠানে আমাদের আমন্ত্রণ কিংবা কখনও স্মরণ করা হয় না।

মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু এবং শেষ হয়। পড়াশুনা শেষ করার পর ১৯৭৯ সাল খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বর্তমান সরকারি শাহপুর মধুগ্রাম কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু। দৌতলতপুর মহসিন গার্লস কলেজ এবং বর্তমান মহসিন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দৌতলতপু (দিবা/নৈশ্য) কলেজে একটানা ২৯ বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন এবং অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে আলহাজ্ব অধ্যাপক খন্দকার গোলাম মোস্তফা এক পুত্র সন্তানের জনক।ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়র, দীর্ঘদিন থেকে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন আমেরিকাতে। বর্তমানে তিনি দৌলতপুর পাবলাস্থ নিজ বাড়িতে অবসর জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রিয়তমা স্ত্রী ওয়াজিফা খাতুন রোজির মৃত্যুর পর তিনি শোকে মুহ্যমান ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। সেই একাকীত্ব এবং অসহায়ত্ব জীবন দূরীভূত করতে ‘দোজাহানের মুক্তির পথ’ নামক একটি বই লেখার কাজ শুরু করেন। যে বইটির মোড়ক তার নিজস্ব বাসভবনে গত ২৪ মার্চ উন্মোচিত হয়। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও তিনি বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ধারন করে আছেন।

মুজিবশতবার্ষিকিতে তাদের মত মুজিবপ্রেমী কর্মীদের স্মরণ-মূল্যায়ন করা হোক এটাই সকলের প্রত্যাশা।

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!