খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ আট কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির
  বিশ্বকাপ বাছাই : মার্টিনেজের ভলিতে পেরুর বিপক্ষে জয় পেল আর্জেন্টিনা
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর এই সময়েও

সব হারিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদের বাস এখন পলিথিন ঘেরা ঝুপড়িতে

রুহুল কুদ্দুস, সাতক্ষীরা

একাত্তরে অস্ত্র হাতে জীবন বাজী রেখে বীরের মতো যুদ্ধ করে যে বাঙ্গালি সন্তানেরা মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন তাদেরই একজন সাতক্ষীরার আবদুল হামিদ। ভাগ্য বিড়ম্বনায় মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর এই সময়েও তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি। বাড়িঘর জমি সব হারিয়ে তার আশ্রয় এখন সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের পরিত্যক্ত গ্যালারির নিচে পলিথিন ঘেরা ঝুপড়িতে।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের নাংলা গ্রামের হারেজ মোল্লার ছেলে আব্দুল হামিদ। আব্দুল হামিদের বড় ভাই ফজল আলী সানা ও একমাত্র বোন অমেলা। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামের নানা জেহের আলী গাজীর বাড়ি থেকে হায়াতখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়াশুনা করাকালিন পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের আব্দুল কাদেরের আহবানে ৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি।ভারতের বহেরায় মাসব্যাপি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অস্ত্র হাতে নিয়ে মাতৃভূমি থেকে শত্রু নিধন যুদ্ধে নেমে পড়েন হামিদ।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরে মেজর জলিল বাহিনীর সদস্য হিসাবে আবদুল হামিদ খুলনা, চুকনগর ও বাগেরহাটের কয়েকটি স্থানে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। তার সহযোগী ছিলেন কয়রার কেরামত আলী ও আব্দুল জব্বার। চাচা রাজাকার আলী সানা খুলনায় রেল লাইনে ফেলে বাবা হারেজ মোল্লাকে ও ভাতের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে বড় ভাই ফজর আলীকে হত্যা করে। পৈতৃক ২০ বিঘা নয় শতক জমি জাল জালিয়াতির মাধ্যমে দখলে রেখেছে আলী সানার আট ছেলে। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরলেও জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে আলী সানার ভয়ে এলাকা ছাড়েন।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

১৯৭৮ সালে প্রতাপনগরের রুইয়ার বিলের মান্দার সানার মেয়ে মোমেনাকে বিয়ে করেন আব্দুল হামিদ। তাদের কোন সন্তান নেই। নাংলা গ্রাম ছেড়ে ৩৫ বছর আগে থেকে বাস করেন সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের পরিত্যক্ত গ্যালারির নীচে পলিথিন ঘিরে। জমি নিয়ে মামলা করে মাঝে মাঝে গ্রামে যেতেন। গত চার বছর যাবৎ শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন আর স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না তিনি। স্ত্রী মোমেনা তাকে নিয়ে ভিক্ষা করে সংসার চালান।

স্টেডিয়ামের নীচ থেকে অনেকেই তাদেরকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রয়াত আইনজীবী এড. তপন কুমার চক্রবর্তী তাদেরকে থাকতে সহায়তা করেন। অনেকেই স্বামী আব্দুল হামিদকে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য মোমেনাকে প্রস্তাব দেয়। বয়সের ভারে ও অসুস্থতার কারণে লাঠির উপর ভর করে ভিক্ষা করে সংসার চালানো ও ঔষধ কিনে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া যেখানে বসবাস করেন সেখানে কোন গরম কাপড় ও একটি মাদুরও না থাকায় মানবেতর জীবন কাটছে হামিদ দম্পতির। অথচ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় হামিদের নাম নেই। কোনো ভাতাও পান না তিনি। যুদ্ধকালিন যে সার্টিফিকেট ও অন্যান্য দালিলিক কাগজপত্র পেয়েছিলেন তাও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। এখন সেই মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ। কিছুক্ষণ কথা বলার পর সারা শরীর কাঁপতে থাকে তার।

আবদুল হামিদ সানা বলেন, শেষ বয়সে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। প্রয়োজনে তার সম্পর্কে যাচাই করে দেখা হোক। অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকতে চান না তিনি। ফিরে পেতে চান পৈতৃক ভিটা। সরকারি কোন ভাতা না পেলেও করোনাকালিন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী তাকে দু’বার চাল দিয়েছে।

মোমেনা খাতুন বলেন, তাদের কোন সন্তান নেই। স্যাতসেতে জায়গায় থেকে তার স্বামী আব্দুল হামিদের দিনের পর দিন শরীর ভেঙ্গে পড়ছে। এখন ভিক্ষা করতে নিয়ে যাওয়া ও কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বামী মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা পেলে তিনি খুশী হবেন। পেতে চান বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে থাকার মত একটু জায়গা।

আশাশুনি নাংলা গ্রামের ইউপি সদস্য মোঃ রফিকুল ইসলাম রফি জানান, তার গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অনেক জায়গায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু অনেক আগে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় তিনি কোন কাগজপত্র করতে পারেননি। সম্ভব হলে তার জন্য কিছু করার অনুরোধ জানান তিনি।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

আনুলিয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মোক্তার হোসেন বলেন, আব্দুল হামিদ নামের কোন মুক্তিযোদ্ধার নাম তাদের জানা নেই। তাছাড়া দীর্ঘদিন কয়রা ও সাতক্ষীরায় থাকায় আব্দুল হামিদকে তাদের চেনার কথা নয়। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।

আশাশুনি উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান বলেন, বিষয়টি জানার পর তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সহযোগী হিসেবে কয়রার মুক্তিযোদ্ধা কেরামত আলী ও আব্দুল জব্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হলে অবশ্যই যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য তিনি সব ধরণের চেষ্টা করবেন। মঙ্গলবার (১৫ডিসেম্বর) দুপুরে তিনি পলাশপোল স্টেডিয়াম এলাকায় যেয়ে আব্দুল হামিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলার সময় হামিদের শারীরিক অবস্থা ও বাসস্থান দেখে কষ্ট পেয়েছেন। আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধা জীবদ্দশায় সম্মান না পেলেও অনেক রাজাকার পন্থিরা আর্থিক সুবিধা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন।

আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা বলেন, সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পেরে আব্দুল হামিদ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে তিনি উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে যদি তিনি মুক্তিযোদ্ধা নাও হন তাহলেও তাকে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর গৃহযোজনার আওতায় বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!