স্বপ্নের পদ্মা সেতু ২৫ জুন ২০২২ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। শতবাধা বিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে নির্মিত বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু অন্য কোন সেতুর মত একটা সেতু না, পদ্মা সেতু বাঙালি জাতির অহংকার ও সক্ষমতার প্রতীক।
পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের এক উজ্জ্বল মাইলফলক যা অর্জিত হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে। যেদিন থেকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে সে দিন থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অন্তরে বইছে যেমন আনন্দের ঢেউ, ঠিক অনুরুপভাবে সারা বাঙালি অপেক্ষা করছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য ।স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে বদলে দেবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলার মানুষ পদ্মা নদীর উপর একটি সেতুর স্বপ্ন দেখেছিলো বহুকাল আগে থেকেই। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাই তিনি এই অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-কষ্ট বোঝেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হবার দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করেন। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া ফেরিঘাটের কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা বহুমুখী সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন । কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনঃনির্বাচিত না হওয়ার কারনে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের অগ্রাধিকার হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার পদ্মা সেতু নির্মাণকে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে অগ্রাধিকার তালিকায় নিয়ে আসেন।
শুরুতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিবি), জাইকা, আইডিবি এই সেতুর অর্থায়নের অংশীদার হলেও পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক যুক্ত হয়। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয় পদ্মা সেতু নির্মাণে। বিশ্বব্যাংক মিথ্যা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে সেই সেই ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয় এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু কন্যা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়েই নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। দীর্ঘ কর্মযজ্ঞের কাজ শেষ করে মূল সেতুর কাজ ইতোমধ্যে শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
২০২০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি দেখা না দিলে অনেক আগেই চালু হয়ে যেত নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বাংলাদেশের মেগা প্রকল্প ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। শুরু থেকেই নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে রাজনৈতিক, কারিগরি ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। পদ্মা সেতু মেগা প্রকল্পটি আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির এক অনন্য প্রতীকে পরিণত হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব অর্থায়নে মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে স্থান করে নিয়েছেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আমাদের দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষ হতে যাচ্ছে। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন করবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ অপেক্ষায় আছে সুবর্ণ দিনের সোনালি ভোরের আশায়।
পদ্মা সেতুর কারনে ঢাকার সঙ্গে সহজ যাতায়াত প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাড়বে শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ, স্থাপন করা হবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা। পদ্মা সেতুর কারনে নগরায়ণের গতি বৃদ্ধি পাবে। কৃষিতে আসবে নতুন বিপ্লব। বাড়বে কর্মসংস্থান। বিকশিত হবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প। পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন কোটিরও বেশি মানুষ।
পদ্মা সেতুর কারণে পরিবহণ সহজ হওয়ায় রপ্তানি বাণিজ্যের লিডটাইম কমে যাবে। ফলে ব্যবসায়ীদের রিটার্ন বা লাভ বেড়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে টাকাও হাত ঘুরবে দ্রুত হারে। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে বহুমুখিতা। বাড়বে মানুষের আয়-রোজগার। বাড়বে ভোগ ও চাহিদা। আর সে কারণেই দক্ষিণাঞ্চলে বাড়বে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ।
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক লাভের হার (ইআরআর) ১৮-২২ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে একত্রিশ বছরের মধ্যেই এ সেতুর পুরো খরচ উঠে আসবে। সেতু চালু হওয়ার পর উপযুক্ত সহায়ক সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা গেলে আরও কম সময়ের মধ্যে এ বিনিয়োগ বাবদ অর্থ পুরোপুরিই উঠে আসবে।
বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর উত্তরবঙ্গে যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের আর্থসামাজিক পরিবর্তন আরও দ্রুত লয়ে ঘটবে। কেননা পদ্মা সেতুর কারণেই আঞ্চলিক যোগাযোগ এক নতুন মাত্রা পাবে। ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ের সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের সংযোগ ঘটবে। তাছাড়া তামাবিল থেকে বেনাপোল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের ফলে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যে বিস্ফোরণ ঘটবে। পদ্মা সেতু তৈরির আগে করা সমীক্ষায় আরও বলা হয়, পদ্মা সেতুর সরাসরি সুফল ভোগ করবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কি পরিবর্তন হবে তা নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদরা মডেলিং করে দেখিয়েছেন যে, স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে বছরে ১.২৬ শতাংশ জাতীয় জিডিপিতে যুক্ত হবে। পদ্মা সেতু চালুর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপিতে যুক্ত হবে প্রায় ৩.৫০ শতাংশ। ট্রান্স এশিয়ান রেল ও সড়ক পদ্মা সেতুর মাধ্যমেই যুক্ত হবে। পদ্মা করিডরে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ চালু হলে আরো গতিশীল হয়ে উঠবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি। সেতুটির কারণেই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোর আওতায় আসবে।
পদ্মা সেতুর সাথে রেলের যুক্তের প্রভাবে প্রতিবছর জাতীয় জিডিপিতে আরও ১.০০ শতাংশ যুক্ত হবে । ২০২৪ সাল নাগাদ ২৪ হাজার যান চলাচল করবে পদ্মা সেতু দিয়ে। বছর বছর তা বাড়বে এবং আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৭ হাজারে। একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বছরে প্রায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.০৪ শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। বছরে এক শতাংশেরও বেশি দারিদ্র্য কমে আসবে। প্রতি বছরে দুই লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে এবং আগামী ৫ বছরে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এমনকি, দশ বছর পর এ সংখ্যা তিনগুণ হয়ে যাবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের অংশ হিসাবেই সেতুর আশপাশে অনেকটা নদীর পাড় নদী শাসনের আওতায় আনা হয়েছে। যারফলে পদ্মা সেতু এলাকার নদীভাঙন রোধ করা সম্ভবপর হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদেরকে জমির দামের কয়েকগুণ ক্ষতিপূরণ ছাড়াও পরিকল্পিত উপায়ে তাদেরকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। কর্মসংস্থান, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র কমবে। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নয়, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র বিমোচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতুর কারনে দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষাসহ মানব উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতির ভিত্তি তৈরি হয়েছে। তাই আমরা আশা করছি, পদ্মা সেতুর কল্যাণে দক্ষিণ বাংলায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
২৫ জুন ২০২২ স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য অর্থনৈতিক মুক্তির মহাসড়কে আরেকটি মাইলফলক স্থাপন করতে যাচ্ছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শতবাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বাঙালি জাতি যে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে তার আরো একটি মাইলফলক স্পর্শ করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরো বাঙালি জাতির মননে ‘আমরাও পারি’ ধারণাটি গেঁথে দেবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের তিন কোটি মানুষের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি জাতির পিতার স্বপ্নের সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ তথা রুপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে মর্মে আমরা আশাবাদী।
(লেখক : উপসচিব ও কনসালটেন্ট, এটুআই)