খুলনা, বাংলাদেশ | ২২ বৈশাখ, ১৪৩১ | ৫ মে, ২০২৪

Breaking News

  মিল্টন সমাদ্দারের প্রতারণায় সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী : ডিবি প্রধান
  জনগণের ভরসাস্থল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন সেনাবাহিনী : প্রধানমন্ত্রী

৩০ বছর আগে ভারতে পাচার রেজিয়া, যেভাবে ফিরলেন গ্রামে

গেজেট ডেস্ক

ভারতের কাশ্মিরে পাচার হওয়া রেজিয়া খাতুন নিজ দেশে বাড়িতে ফিরে দেখলেন মা-বাবা মারা গেছেন। ভাই-বোনরা বৃদ্ধপ্রায়। সন্তানরা বড় হয়ে বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। অন্যদিকে রেজিয়ার জীবন থেকে কেটে গেছে ৩০টি বছর।

১০ দিন আগে কাশ্মিরের বন্দি জীবন থেকে পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন মেহেরপুর সদর উপজেলার সুবিধপুর গ্রামের গৃহবধূ রেজিয়া খাতুন (৪৫)। এতদিন পরিবারের কাছে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। পরিবার ও গ্রামবাসী জানতো রেজিয়া মারা গেছে।

এখন হারানো রেজিয়াকে এক নজর দেখতে আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ প্রতিদিন ভিড় করছে সুবিধপুর গ্রামে রেজিয়ার পৈত্রিক বাড়িতে। ৩০ বছর আগে এক রাতে রেজিয়াকে তার দ্বিতীয় স্বামী আজগর আলী ও প্রতিবেশী জয়নাল আবেদীন মারধর করে অচেতন অবস্থায় সীমান্তের তাঁরকাটা পেরিয়ে ভারত অভ্যন্তরে নিয়ে কাশ্মিরের ফারুক হোসেনের কাছে রেজিয়াকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কাশ্মিরের নিভৃত বড় বিরু গ্রামের একটি এলাকায় রাখা হয়েছিল তাকে।

রেজিয়া খাতুন জানান, ৩ মাস আগে জম্মু কাশ্মির থেকে ভারতের নদীয়া জেলার পন্ডিতপুর গ্রামে পায়ের চিকিৎসা নিতে যান তিনি। সেখানে রেজিয়ার নিজ গ্রামের পাশের গ্রাম কসবা হিন্দি গ্রামের একজনের সাথে পরিচয় হয়। বৈবাহিক সূত্রে সে ভারতীয় জামাই। তাকে কাশ্মির যাওয়ার পুরো ঘটনাসহ গ্রামে মা-বাবা-ভাইদের কাছে তার বেঁচে থাকার খবর পৌঁছে দিতে বলে। পরে পরিবারের লোকজন বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে তাকে কাশ্মির থেকে মেহেরপুর ফিরিয়ে আনে।

রেজিয়াসহ স্থানীয়রা জানান, ১৫ বছর বয়সে পারিবারিকভাবে গাংনী উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের সাত্তার আলীর সাথে বিয়ে হয় রেজিয়া খাতুনের। সেই সংসারে ১ ছেলে ১ মেয়ে রেখে নিজ গ্রামের আজগর আলীর সাথে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের পর আজগর আলীর নির্যাতন মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ৩০ বছর আগে এক রাতে নির্যাতন শেষে তাকে সীমান্তের মাঠের মধ্যে নিয়ে অবচেতন অবস্থায় স্বামী আজগর ও প্রতিবেশী জয়নাল মিলে তাঁরকাটা পার করে ভারতে নিয়ে কাশ্মিরের ফারুক হোসেনের কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর জ্ঞান ফিরলে সে এখন কাশ্মিরে বলে জানতে পারে। ৭/৮ বছর সে বাকরুদ্ধ অবস্থায় ছিল।

দেশে ফিরে রেজিয়া খাতুন তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য দ্বিতীয় স্বামী আজগর ও প্রতিবেশী জয়নালের বিচার চেয়ে মামলা করেছেন।

জানতে চাইলে অশ্রুশিক্ত হয়ে রেজিয়া বলেন, ৩০ বছর সীমাহীন কষ্টে বন্দিজীবন পার করেছি। ছেলেমেয়েরা মায়ের আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে বড় হয়েছে। নিখোঁজ অবস্থায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। তাদের মৃত্যুর সংবাদ বা তাদের মরা মুখটাও দেখতে পাইনি। জীবনের সুন্দর সময়গুলো অসুন্দরভাবে পার করেছি। আর কারো জীবন যেন এভাবে ধ্বংস না হয় সেজন্য মেহেরপুর সদর আদালতে মানবপাচার আইনে মামলা করেছি। আদালত মামলা আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

ভারতের পন্ডিতপুরে রেজিয়ার সাথে দেখা হওয়া পাশের গ্রামের আমিরুল ইসলাম বাবলু জানান, ৩ মাস আগে ভারতের নদীয়া জেলার পন্ডিতপুর গ্রামে তার শশুর বাড়িতে যায়। সেখানে স্থানীয় হাসপাতালে এক চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভারতে পাচার হওয়া রেজিয়ার সাথে তার পরিচয় হয়। সেখানে রেজিয়ার মুখে সব শুনে তিনি মেহেরপুর ফিরে রেজিয়ার ভাইদের সন্ধান পেলে তাদের পুরো ঘটনা খুলে বলেন। রেজিয়ার দেওয়া মোবাইল নম্বর ও কাশ্মিরের ঠিকানা অনুযায়ী সেখানে গিয়ে ফারুকের কাছ থেকে রেজিয়াকে উদ্ধার করে আনে তার পরিবার।

রেজিয়ার বড় ভাই আনারুল ইসলাম বলেন, রেজিয়ার স্বামী আজগর এতদিন বলতো রেজিয়া ওই রাতে কাউকে না বলে নিখোঁজ হয়ে যায়। দেশের প্রায় জেলায় বোনের সন্ধানে গেছি। কোথায় সন্ধান পায়নি। ভেবেছি বোন হয়ত মারা গেছে। ৩ মাস আগে পাশের গ্রামের আমিরুলের মাধ্যমে বোনের সন্ধান পেলে আমরা ভারতের কাশ্মির গিয়ে ৩০ বছর ধরে হারানো বোনকে ফিরিয়ে আনি।

রেজিয়ায় ভাইয়ের ছেলে লিটন হোসেন বলেন, ‘আমরা এতদিন ফুফুকে ছবিতে দেখে বড় হয়েছি। এখন সশরীরে ফুপুকে কাছে পেয়ে খুবই খুশি আমরা।’

রেজিয়ার মেয়ে সালেহা খাতুন বলেন, ছোট থেকে মায়ের স্নেহ-আদর থেকে বঞ্চিত ছিলাম। মাকে ফিরে পাবার জন্য আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করতাম। আল্লাহ আমার ডাক শুনেছেন। আমি আমার মাকে ফিরে পেয়েছি। ৩০ বছর পর মাকে ফিরে পেয়ে যেন জীবন ফিরে পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে। যারা আমার মাকে এতদিন আমার কাছ থেকে দূরে রেখেছিল আমি তাদের কঠিন বিচার চাই।

অভিযুক্ত দ্বিতীয় স্বামী আজগর আলী জানান, বিয়ে হওয়ার পর কয়েক বছর সংসার হয়। তারপর সামাজিকভাবে রেজিয়ার সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তিনি পাচারের বিষয়ে কিছু জানেন না।

অন্যদিকে জয়নাল বলেন, যড়যন্ত্র করে রেজিয়ার হারানো ঘটনার সাথে তাকে যুক্ত করা হচ্ছে।

কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আরিফুল ইসলাম জানান, আমরা জানতাম রেজিয়া মারা গেছে। ৩০ বছর পর রেজিয়ার ফিরে আসার কাহিনী শুনে জানতে পারি রেজিয়ার দ্বিতীয় স্বামী তাকে ৩০ বছর আগে কাশ্মিরে এক লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। এখন সে তার নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছে। তার ফিরে আসার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে কয়েক গ্রামের মানুষ রেজিয়াকে দেখতে ভিড় করছে। আমরা ভুক্তভোগীর পাশে আছি। তাকে সব ধরনের আইনি সহায়তা করা হবে।

মেহেরপুর নারী ও শিশু নির্ষাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের পিপি একেএম আছাদুজ্জামান জানান, রেজিয়ার ঘটনা নিয়ে মামলা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ ভিকটিম রেজিয়াকে আইনি সব ধরনের সহায়তা দেবে।

খুলনা গেজেট/ এএজে




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!