খুলনা, বাংলাদেশ | ২৬ বৈশাখ, ১৪৩১ | ৯ মে, ২০২৪

Breaking News

  প্রথম ধাপের উপজেলা ভোট শেষ, চলছে গণনা
  উপজেলা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ : রিজভী
  তেঁতুলিয়ার খয়খাটপাড়া সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত

ভাল নেই মশিয়ালীর ত্রিপল মার্ডারে নিহতদের পরিবার (ভিডিও)

সাগর জাহিদুল

দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাড়া করে হিরা বেগমকে। মেনে নিতে পারেনি অসময়ে ছেলের মৃত্যু। সাইফুলের কথা মনে পড়লেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকেন। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। বিড়বিড় করে বলতে থাকেন শয়তানরা আমার নাড়ি ছেড়া ধনকে গুলি করে হত্যা করেছে। বৃহস্পতিবার মনের আক্ষেপ নিয়ে কথা বলছিলেন নগরীর খানজাহান আলী থানার মশিয়ালী এলাকার ত্রিপল মার্ডারে নিহত সাইফুল ইসলামের মা।

সে রাতের কথা এখনও ভুলতে পারেননি একই ঘটনায় নিহত রসুলের স্ত্রী নাসিমা বেগম। স্বামী জীবিত অবস্থায় কখনও বাড়ি থেকে বের হননি। খাবারের সন্ধানে তাকে এখন বাইরে বের হতে হয়। স্বামীর কথা বলতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। কখনও ভাবতে পারেননি তাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবে। সংসার চালতে গিয়ে চোখে দেখছেন অন্ধকার। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ তার। এরমধ্যে শ্বাশুড়ির অসুস্থতা তাকে আরও বিপদে ফেলে দিয়েছে।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে হিরা বেগম বলেন, ২০২০ সালে ১৬ জুলাই এশার আযানের কিছুক্ষণ পরে সাইফুল ঘর থেকে বের হয়। ফিরে এসে ভাত খাবে বলে মাকে জানিয়ে যায়। তিনি প্রস্তুতিও নিতে থাকেন। এরপর কয়েকটি গুলির শব্দ। রাস্তায় নেমে দেখেন, মানুষ এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে। পরে জানতে পারে এখানে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখনও তিনি জানতে পারেনি ছেলের মৃত্যু হয়েছে। পরে যখন জানানো হল তখন তার মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ছেলের নিথর দেহ দেখতে পান। ছেলের বাবা সাইদুল ইসলাম আলীম জুট মিলের স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বন্ধ হওয়ার পর তাদের সংসারের অবস্থা খারাপ। ঠিক সে সময়ে সংসারের হাল ধরে সাইফুল। অন্যের জমি হারি নিয়ে ঘের করতো। সংসারের অবস্থাও ফিরে এসেছিল। ছেলের মৃত্যুর পর সংসারে দেখা দিয়েছে অভাব অনটন। সংসারের উপর্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তারা দিশেহারা।

হিরা বেগম আক্ষেপের সাথে বলেন এখন অপেক্ষা শুধু বিচারের। আমাদের যারা এতবড় ক্ষতি করেছে তাদের বিচার যেন দুনিয়া থেকে দেখে যেতে পারি।

রসুলে স্ত্রী নাসিমা বেগম জানান, সে রাতে ছোট মেয়ে সোনিয়ার বমি শুরু হয়। রাস্তায় বের হয় খাবার স্যালাইন কিনতে। এরমধ্যে পরপর গুলির শব্দ। সন্ত্রীদের গুলিতে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। মেয়ের বাবার মৃত্যুর পর সংসার চালাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। দিনমজুর ছিলেন তিনি। সংসারে কোন অভাব ছিল না। খাবারের জন্য কোনদিন বাইরে বের হতে হয়নি। স্বামীকে হারিয়ে ঘরে এখন ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ তার। পাঁচ সদস্য নিয়ে বিপদের মধ্যে আছেন তিনি। শ্বাশুড়ির অসুস্থতা বিপত্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অভাবের মধ্যে তার জন্য নিয়মিত ঔষধ কিনতে হয়। যার জন্য মানুষের নিকট হাত পাততে হয় তাকে। তিনি এ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া জাকারিয়া ও জাফরিন কারাগারে থেকে বের হয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এ নিয়ে তিনি শঙ্কিত।

অভাব অনটনের মধ্যে দিন পার করছে মশিয়ালী ট্রিপল মার্ডারে নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। গত দেড় বছর ধরে তিন সন্তানকে নিয়ে বিপদের মধ্যে রয়েছেন। কেউ কোন খবর নেয় না। স্থানীয় একটি জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন। এ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার চেয়েছেন তিনি।

এক ছেলে ও দু’মেয়ে নিয়ে মশিয়ালীর পূর্বাপড়ায় বসবাস করেন। সন্তানদের নিয়ে শঙ্কিত। জামিন পেলে দেখে নেওয়ার হুমকি রয়েছে অব্যাহত। ভয় বেশী ছেলেটাকে নিয়ে। সে খানজাহান আলী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় তাকেও হত্যা করা হয় কি না তা নিয়ে শঙ্কায় থাকেন।

ভয়াবহতার কথা জানাতে গিয়ে বার বার কাঁদছিলেন তিনি। সেদিন রাতে নজরুল ও চাচাতো ভাই মো: রেজাউল শেখ আড়াতলা মাদ্রাসা সংলগ্ন মোড়ে বসে চা খাচ্ছিল। ৪০ জন লোক একসাথে হেঁটে আলীম জুটমিল থেকে মশিয়ালী পূর্বপাড়া বাড়ি ফিরছিল। এর আগে থেকে প্রতিপক্ষের প্রায় একশ’ লোক আড়াতলা মোড়ে অবস্থান নেয়। দেখামাত্র তারা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। ওই সময়ে নজরুলও প্রাণ হারায়। বাড়ি লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। ঘরে থাকায় কারও কোন সমস্যা হয়নি।

আলীম জুট মিল মসজিদের ইমাম মাসুম বিল্লাহ ত্রিপল হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “জাকারিয়া ও জাফরিন এলাকার খারাপ মানুষ। তাদের অপকর্মের জন্য এলাকাবাসি ক্ষুব্ধ। ঘটনাটি অন্যদিকে নেওয়ার জন্য ত্রিপল মার্ডারের মতো জঘন্যতম ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। এলাকাবাসি তাদের এখানে দেখতে চায় না।”

২৫ অক্টোবর খানজাহান আলী থানার আলোচিত ট্রিপল মার্ডারের অভিযোগপত্র দাখিল করেন মহানগর গোয়েন্দা শাখার পুলিশ পরিদর্শক রাধে শ্যাম। চার্জশিটে ২২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ জাকারিয়া, তার বড় ভাই শেখ মিলটন, তার ছোট ভাই মহানগর ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি শেখ জাফরিন হাসান, জাকারিয়ার চাচাতো ভাই রেজওয়ান শেখ রাজু ও জাহাঙ্গীর, জাফরিনের শ্যালক আরমান হোসেন, রহিম আকুঞ্জিসহ ১৫ জন গ্রেপ্তার এবং ৭ জন পলাতক রয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ১৫ জন আসামির মধ্যে ১১ জন বিভিন্ন সময়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মামলাটি বর্তমানে বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে জানা গেছে।

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!