খুলনা, বাংলাদেশ | ১৩ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  মানিকগঞ্জের গোলড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গাড়িচাপায় দুই সবজি বিক্রেতা নিহত
  গাজীপুরের শ্রীপুরের একটি বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার
  চুয়েটে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু
  বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনায় আজ জরুরী সিন্ডিকেট সভা আহ্বান

বিলুপ্তির পথে মৃৎশিল্প

অভয়নগর প্রতিনিধি

আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচির পরিবর্তনের ফলে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি নানা রকম আধুনিক সামগ্রী। এ কারণে চাহিদা কম, কাঁচামালের চড়ামূল্য, সর্বোপরি পুঁজির অভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অভয়নগরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। গ্রাম বাংলার একটি প্রাচীন শিল্পের নাম মৃৎশিল্প। যা এক সময় মানুষের ঘরে ঘরে শোভা পেতো। কিন্তু সময়ের বির্বতনে হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। এখন আর হাট-বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে আগের মত দেখা যায়না। মাটির পন্যের বদলে প্লাষ্টিক ও এলোমিনিয়ম পন্য বেশি ব্যবহার হওয়ায় এই শিল্প হারাচ্ছে তার জৌলুস।

বিলুপ্তির পথে চলিশিয়া ইউনিয়নে পালপাড়া এলাকার ৩০ থেকে ৩৫টি পরিবারের কয়েকশত মানুষ যুগ যুগ ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। যাদের কর্মের মাধ্যেমে এই শিল্পের বিভিন্ন সামগ্রী দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সরবরাহ করা হতো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আগের মত এ শিল্পের কদর না থাকায় মাত্র ৮-১০ টি পরিবার এ পেশায় জড়িত রয়েছে। পরিবার গুলোর মানুষ সারা বছর মাটির হাঁড়ি-পাতিল, ঢাকনা, কলসি, ফুলের টবসহ নানা উপকরণ তৈরি করে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করছে। ইতিহাসের ঐতিহ্যের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে, মৃৎশিল্পের জন্য অভয়নগরে এক সময় ছিল খুবই পরিচিত। কিন্তু কালের আবর্তে আজ তা বিলীন হতে চলেছে। ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে এ পেশার আকাল। হয়তো বা এমন দিন আসবে, যেদিন বাস্তবে এ পেশার অস্তিত্ব মিলবে না। শুধুমাত্র খাতা-কলমেই থাকবে সীমাবদ্ধ। চলিশিয়া ইউনিয়নের পালপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, এ পেশার অনেকেই এখন পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিয়ে কেউ বা রিকশা চালান। আর কেউ বা দিনমজুরের কাজ করছেন। যারা এ পেশা ছাড়তে পারেননি।তাদের অনেকেই শিক্ষা, চিকিৎসাসহ আধুনিক জীবনযাত্রার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় উপনিত হয়েছেন। উপজেলার ধোপাদী গ্রামে এক সময় ২৫/৩০ পরিবার এ পেশায় জড়িত ছিল। কিন্তু বর্তমানে ৩টি পরিবার এ কাজ করে থাকে।

মৃৎশিল্পী শংকর পাল জানান, আমার বাড়ির পাশে অনেকেই এ পেশায় নিয়োজিত ছিল। এখন অন্য পেশায় চলে গেছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে মানুষের ব্যবহারিক জীবনে মৃৎশিল্পের আর বিশেষ ভ‚মিকা নেই। একটা সময় ছিল যখন মাটির তৈরি হাঁড়ি- পাতিল, থালা-বাসন, সানকি, ঘটি, মটকা, সরা, চারি, কলস, সাজ, ব্যাংক, প্রদীপ, পুতুল, কলকি, দেবদেবীর মূর্তি ও ঝাঝরের বিকল্প ছিল না। ঋণ প্রদানে অনীহা ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রযুক্তি বিকাশের এ যুগে এ শিল্পের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধিত না হওয়ায় তা আজ আর প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অনেকে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আগেকার দিনে মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন এঁটেল মাটি, রঙ, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি ছিল সহজলভ্য। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রয়োজনীয় উপকরণের দুমূর্ল্যের কারণে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। পূর্বে যেখানে বিনামূল্যে মাটি সংগ্রহ করা যেত, বর্তমানে এ মাটিও অগ্রিম টাকায় কিনতে হচ্ছে। সাধারণত মৃৎপাত্র গুলো কুমার পরিবারের নারী- পুরুষ উভয়ে মিলেমিশে তৈরি করে থাকেন। তৈরিকৃত সামগ্রী বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা এসে কিনে নেন। অনেকে আবার বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করেন। বর্ষা মৌসুমে কাজ বন্ধ থাকায় কুমারদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ যায়। এ সময় কুমাররা সারা বছর কাজ করার জন্য এঁটেল মাটিসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহে নেমে পড়েন। পুঁজির অভাবে অনেকে মহাজনের কাছ থেকে চড়াসুদে টাকা ঋণ নেন। শুষ্ক মৌসুমে কাজ করে যা উপার্জন হয় তার বেশির ভাগই চলে যায় মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে। এভাবে কুমার সম্প্রদায় যুগযুগ ধরে থেকে যাচ্ছেন সহায় সম্বলহীন হয়ে। মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য আজ বহুলাংশে বিলুপ্ত হচ্ছে।

শুধু এ এলাকা নয়, গোটা দেশে এ পেশায় নেমে এসেছে নেমে এসেছে এক চরম বিপর্যয়। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।  এ শিল্পের মাধ্যমে একদিকে যেমন আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি, তেমনিভাবে প্রাচীন সভ্যতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে এ পেশাটি। এর মাঝেই জাতির ইতিহাস খুঁজে পাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। চলিশিয়া ইউনিয়নে পালপাড়ার মৃৎশিল্পের সাথে জড়িতরা বলছেন, প্লাষ্টিক ও এ্যালোমিনিয়ম সহজ লভ্য হওয়ায় এখন মাটির তৈরি পন্য প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, পাশাপাশি দিন দিন বাড়ছে কাচাঁমালের খরচ। ফলে বাড়তি খরচ ও বাজারের চাহিদা না থাকায় পেশা বদলে বাধ্য হচ্ছি আমারা।

তারা আরো বলছেন, সরকারি ভাবে সকল সহযোগিতা পেলে অভয়নগরে আবারও হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দীন বলেন, উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে মৃৎশিল্পের সাথে জড়িতরা যদি আগ্রহী হয় তবে তাদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ ফরিদ জাহাঙ্গীর বলেন, প্লাষ্টিক ও এ্যালোমিনিয়ম পন্য বাজার দখল করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা কি ভাবে আবার এই শিল্পকে পুনর্জীবিত করতে পারে, আবার তাদের পণ্য বাজারে সরবরাহ করতে পারে, এই বিষয়ে তাদের সাথে মতবিনিময় করা দরকার। এছাড়া আমাদের পক্ষে যতটুকু সহযোগিতা করা সম্ভব আমরা আন্তরিক ভাবে সহযোগিতা করবো।

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!