খুলনা, বাংলাদেশ | ১৪ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  চাওয়াই নদীতে গোসলে নেমে প্রাণ গেল দুই শিশুর
  গরুবাহী নছিমনের ধাক্কায় মোটরসাইকেলের দুই আরোহী নিহত
  জামালপুরে ধান মাড়াই করতে গিয়ে তাঁতী লীগ নেতার মৃত্যু
  দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২

কপোতাক্ষের ভয়াবহ ভাঙ্গনে হুমকির মুখে পাইকগাছার বিস্তীর্ণ অঞ্চল

শেখ নাদীর শাহ্, পাইকগাছা

সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।

মাইকেল মধুস‚দন দত্ত’র বিখ্যাত তপোতাক্ষ নদ কবিতার পংক্তিমালা কিংবা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ’’এ-ক‚ল ভাঙে ও-ক‚ল গড়ে এই তো নদীর খেলা। —– শেষে শ্মশান ঘাটে গিয়ে দেখে সবাই মাটির ঢেলা, এই তো বিধির খেলা রে ভাই ভব নদীর খেলা।

নদীর প্রতি অসীম ভালবাসা, নদীর প্রতি অজস্র আবেগের গুচ্ছমালায় কবি সাহিত্যিকরা অসংখ্য কবিতা, গান কিংবা সাহিত্য রচনা করে গেলেও সেই নদীর প্রতি ভাবাবেগে আজ যেন চিঁড় ধরেছে। নদী শাষণ-শোষণে কিংবা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে একে একে হারিয়ে যেতে বসেছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীমালা। যার ধারাবাহিকতায় বেশ আগেই যুক্ত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী কপোতাক্ষ নদ।

প্রথমে আগ্রাসী কপোতাক্ষের ভাঙ্গন ও পরে নাব্যতা হ্রাসে নদী তীরে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর পড়ে বিরুপ প্রভাব। ভিটা-বাড়ি হারিয়ে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। জীবিকার তাগিদে পেশা বদলও ঘটেছে অনেকের। এরপর গণদাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ খনন করে। নদের একাংশ ফিরে পায় তার হারানো যৌবন। তবে কপোতাক্ষের ফের ভাঙ্গনে নতুন করে উদ্বাস্তু হচ্ছে নদী তীরে বসবাসকারী বহু পরিবার। হুমকির মুখে পড়েছে সরকারের বহু উন্নয়ন প্রকল্প। চরম ঝুঁকিতে রয়েছে মুজিব শত বর্ষে গৃহহীন ও ভূমিহীন বহু পরিবারের পুণর্বাসনে গড়া আবাসন প্রকল্পসহ হাট-বাজার, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অথচ এদিকে নূন্যতম খেয়াল নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

ইতোমধ্যে কপোতাক্ষের পাইকগাছার কপিলমুনি ইউনিয়নের কাশিমনগর হাট-বাজার, মসজিদ, দোকান-পাঠ ও ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন (সি আর এম আই ডিপি) প্রকল্পের নির্মাণাধীন চার তলা ফাউন্ডেশন কাশিমনগর হাট দুই তলা বিশিষ্ট গ্রামীণ মার্কেট বিল্ডিং, মুজিবশত বর্ষের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের আবাসন প্রকল্প চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। কপোতাক্ষ পাড়ের বনায়ন প্রকল্পের সিংহভাগ গাছ ইতোমধ্যে গিলে খেয়েছে আগ্রাসী কপোতাক্ষ। রামনাথপুরের বহু ঘর বাড়ি, এতিমখানা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কয়েক শ’ একর জমি কপোতাক্ষে বিলীন হয়েছে। বর্তমানে কপিলমুনির নতুন মাছ কাটা থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী কালীবাড়ী ঘাট, হাট-বাজার, কাশিমনগর জেলেপাড়া, গোলাবাটিসহ রাড়ুলী ইউনিয়নে কপোতাক্ষ নদের ভাঙ্গন ফের ব্যাপক আকার ধারণ করছে। ইতোমধ্যে সেখানকার জেলে পল্লীর অন্তত ৭০ টি পরিবার ভাঙ্গনের মুখে অন্যত্র চলে গেছে। নদীগর্ভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে আরো ২০ টি পরিবারের বসত ভিটা। নদী গর্ভে বিলীণ হয়ে গেছে সেখানকার চলাচলের একমাত্র রাস্তার দুই তৃতীয়াংশ। জোয়ারের পানি ঠেকানোর জন্যও সেখানে নেই কোন বাঁধ। ফলে প্রতি অমাবশ্যা-পূর্নিমায় জোয়ারে পানি বাড়লে এলাকায় লবণ পানিতে প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা, ফসলি জমি ও কাঁচা-পাকা ঘর-বাড়ি। এছাড়া ভয়াবহ ভাঙ্গন শুরু হয়েছে বোয়ালিয়া জেলে পাড়া, রামনাথপুরসহ কপোতাক্ষের বিভিন্ন এলাকায়।

এব্যাপারে কথা হয় কপিলমুনির কাশিমনগর জেলে পল্লীর বাসিন্দা উত্তম বিশ্বাসের সাথে। তিনি জানান, একশ’ বছরেরও বেশী সময় ধরে তারা সেখানে বসবাস করে আসছেন। তবে ইতোমধ্যে তাদেরসহ বহু পরিবারের মূল বসত-ভিটা গিলে খেয়েছে আগ্রাসী কপোতাক্ষ। অনেকেই পেশা বদলে অন্যত্র চলে গেছে। উদ্বাস্তু হয়েছে অনেক পরিবার। তার নিজেরও দু’বার বসতি বদল হয়েছে।

রাড়ুলীর জেলে পল্লীর বাসিন্দা ভূধর বিশ্বাস তার সাথে যোগ করে বলেন, আমার বাবা ও দাদুরা প্রায় ১শ’ বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছেন। নদীর কুলে ১শ’ থেকে দেড়শ বিঘা জমি ছিলো। যেখানে দেড়শ’রও বেশি পরিবারের বসতি ছিল। তবে নদের অব্যাহত ভাঙ্গনের মুখে সেখানকার ৭০ টিরও বেশি পরিবারের ঘর কেড়ে নিয়েছে আগ্রাসী কপোতাক্ষ। যাদের অনেকেই অন্যত্র জমি কিনে পুণর্বাসিত হয়েছে, কারো বা আশ্রয় হয়েছে রাস্তার পাশে কেউবা উঠেছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পে।

একই এলাকার লিপিকা বিশ্বাস জানান, রাতে জোয়ারের সময় ভয়ে বাচ্চাদের নিয়ে বসে থাকেন ভাটার অপেক্ষায়। এরপর ভাটা আসলে ঘুমাতে যান তারা। রাড়ুলীর ৩ নং ওয়ার্ডের ফরিদা বেগম (৫৫) বলছিলেন, তাদের এখনকার বাড়ি ছাড়া নদীর অবস্থান ছিল প্রায় আঁধা কিলোমিটার দুরে। জেলে পল্লীর পরে ছিলো তাদের বসবাস। তারা ছাড়াও প্রায় ৪০ টি পরিবাবারের বসবাস ছিল সেখানে। তবে কপোতাক্ষের ক্রমশ আগ্রাসন জেলে পল্লীর পর এখন তাদেরকেও নদীর কিনারায় নিয়ে ঠেকিয়েছে। যেকোন সময় তাদের ঘর টুকুও নিমজ্জিত হতে পারে ভাঙ্গনে।

একই এলাকার বারিক মোড়ল বলেন, ভাঙ্গনের মুখে তিনি অন্তত তিনবার ঘর পরিবর্তন করেছেন। তার পরেও রান্না ও কাঠের ঘর টুকুও নদীতে চলে গেছে। বাকি ঘরখানিও যেকোন সময় চলে যেতে পারে নদী গর্ভে। সঙ্গতি না থাকায় অন্যত্র জমি কিনে বসবাসেরও উপায় নেই অন্যদিকে সরকারও নদী ভাঙ্গন রোধে কার্যত কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে তাদের দাবি, নদীর অপর পাড়ে গড়ে ওঠা চরে বসতির সরকারি অনুমতি।

রাড়ুলীর বাসিন্দা প্রভাষক ময়েজুর রহমান জানান, গতকাল রাড়ুলী ইউনিয়নের প্রবেশদ্বারের পুরাতন ওয়াপদা রাস্তায় নতুন করে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে সেখান থেকে নদীর পানি প্রবেশ করচে। তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের পরামর্শে স্বেচ্ছাশ্রমে স্থানীয়দের সাথে নিয়ে বাঁধটি আশু মেরামত করেছেন। তিনি আরো বলেন, এর আগে বাঁধটি ২০০৯ সালে আইলায় ভেঙ্গে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাঁধটির স্থায়ী সংষ্কার নাহলে সেখানে ভাঙ্গন প্রসারতা বৃদ্ধি পেয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার আশংকা করেন তিনি।

কপিলমুনি ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়াদ্দার বলেন, রামনাথপুর, আগড়ঘাটা, ভেদামারীসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে কপোতাক্ষের ভয়াহ ভাঙ্গনে সেখানকার বসতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হলেও সেখানকার নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে কার্যত কোন সরকার এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বিভিন্ন সময় এলাকাবাসীর অর্থায়ন ও স্বেচ্ছাশ্রমে তারা যতটুকু সম্ভব কাজ করেছেন। তবে আগামীতে এব্যাপারে সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

কাশিমনগর বাজার ব্যবসায়ি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইউপি সদস্য শেখ রবিউল ইসলাম বলেন, কপোতাক্ষের ভয়াবহ ভাঙ্গন নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বনায়ন প্রকল্প, হাট-বাজারের সিংহ ভাগ ইতোমধ্যে কপোতাক্ষে বিলীণ হয়েছে। নতুন করে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে স্থানীয় আশ্রয়ণ প্রকল্প, মসজিদ, শ্মশানঘাট, নির্মাণাধীন গ্রামীণ মার্কেটসহ নদী তীরের বহু বসতবাড়ি। সর্বশেষ পাউবো’র অর্থায়নে নির্মাণাধীন মার্কেটের পেছনে ১২০ মিটার এলাকায় জিআই ব্যাগ দিয়ে বাঁধ দেওয়া হলেও বাকি এলাকায় ভাঙ্গনের প্রসারতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এব্যাপারে তিনি জরুরী ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাইকগাছা উপজেলা উপ-সহকরী প্রকৌশলী রাজু আহম্মদ বলেন, ভাঙ্গন প্রতিরোধে জরুরী ভিত্তিতে প্রকল্প আওতায় নিয়ে ইতোমধ্যে কপোতাক্ষের ভাঙ্গনকবলিত কাশিমনগর এলাকায় ২শ’ মিটার, গোলাবাটি আশ্রয়ণ এলাকায় ৩শ’ মিটার ও মাহমুদকাটিতে সাড়ে ৩ শ’ মিটার এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!