বুধবার । ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ । ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

৫ বছর ধরে বাঁশঝাড়ের সারগর্তে থাকা বৃদ্ধা মায়ের পাশে দাঁড়ালেন ভারপ্রাপ্ত ইউএনও

চৌগাছা প্রতিনিধি

৩০/৩৫ বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন ছায়রন (৭৫)। স্বামী হারানোর পর অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে মানুষ করেছেন ৪ ছেলে ২ মেয়েকে। চার ছেলের তিনজন বর্তমানে জীবিত। নিজেরা স্বাচ্ছন্দে থাকেন। সবারই আছে ইটের (আধাপাকা) বাড়ি। মেঝো ছেলে আনিছুর ফ্লাট বাড়ি তৈরি করছেন। বাড়িতে এসেছে ২/৩ গাড়ি চলতি মৌসুমের আমন ধান।

তবে মা এখন আর কাজ করতে পারেন না। তাই মাকে বাঁশঝাড়ের গোবরের সারগর্তে গরু ও মানুষের মলমূত্রের মধ্যে একটি ঝুঁপড়িতে রেখেছেন প্রায় পাঁচ বছর ধরে। তবে সেই ঝুপড়িও ছেলেরা তৈরি করে দেননি। নিজের জমানো কিছু টাকা ছিলো। সেই টাকার কিছু দিয়ে ঝুপড়ির দু/তিনখানা টিন কিনে বাশের খুটির উপর বসিয়ে দিয়েছেন ছেলেরা। বাকি টাকাও নিয়ে নিয়েছেন তাঁরা।যশোরের চৌগাছার জগদীশপুর ইউনিয়নের স্বর্পরাজপুর গ্রামে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ঘটেছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বরত সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রকৌশলী কাফী বিন কবির এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ দুটি কম্বল, চাল, ডাল আলুসহ খাবার নিয়ে হাজির হন সেখানে। ব্যক্তিগতভাবে একহাজার টাকা নগদ দেন বৃদ্ধাকে। তিনি সেখানে একটি কাঠের পিড়িতে ইউএনও নিজে বসে বৃদ্ধাকে চেয়ারে বসিয়ে কথা বলেন তাঁর সাথে। শেষে বড় ছেলের পাকা ঘরের বারান্দায় তুলে দেন।

নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য শাহিনুর রহমানকে এসময় নির্দেশ দেন তিন ছেলেকে আগামী দুই দিনের মধ্যে ইউএনও অফিসে যেতে। তিনি বৃদ্ধাকে প্রতিশ্রুতি দেন আপনাকে আর না খেয়ে এভাবে ঝুঁপড়িতে থাকতে হবে না। তবে ইউএনও আসার খবর পেয়েই বাড়িতে তালা দিয়ে সড়ে পড়েন ছেলের বউরা। আগে থেকেই মাঠে কাজ করায় বাড়িতে ছিলেননা বৃদ্ধার ছেলেরা।

এসময় কাফী বিন কবির ছেলেদের বিচার করার কথা বলতেই কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধা। ইউএনওর হাত জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন ‘‘না না না সোনা। ওদের ধরতি হবে না। ওরা জন মাইনে খেটে খাচ্ছে। খাইয়ে যাক। ওদের কিছু বলবেন না।’’

বৃদ্ধা ছায়রন বলেন, সকালে গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য ও স্বর্পরাজপুর দাখিল মাদরাসার সুপার আম্মাদুল তাঁকে খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই খাবার ছাড়া দুপুর পর্যন্ত আর কিছু খাননি। তিনি ইউএনওর কাছে অভিযোগ করেন ছেলে ও পুত্রবধূরা তাঁকে বাড়িতেই যেতে দেন না। মাঝেমাঝে খাবার দিয়ে যান। বিষয়টি গ্রামের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে জানলেও কোন প্রতিকার পাননি তিনি।

ছায়রনের প্রতিবেশি আয়েশা জনান, স্বামীর মৃত্যুর সময় তাঁর ছোট ছেলের বয়স ছিল ৫/৭ বছর। সে ছেলেও মারা গেছেন। ছোট ছেলের মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। এসব অভিযোগ তুলে বাঁশ ঝাড়ে গোবরের সারের গর্তের পাশে ময়লার মধ্যে তাঁকে রেখেছেন ছেলে-বউরা। ঝুপড়িটিও বৃদ্ধার নিজের কাজ করে জমানো টাকার। সেখান থেকেও টাকা নিয়ে নিয়েছেন ছেলেরা। দীর্ঘদিন ধরে বৃদ্ধা রোদবৃষ্টি ঝড়ে এই বাঁশ ঝড়েই থাকেন। কাথাবালিশে পেশাব-পায়খানা করে দিলেও ছেলে-বউরা পরিস্কার করেন না। পাশের জগদীশপুর গ্রামের এক নারী এবং গ্রামের কিছু মানুষ মাঝে মধ্যে পরিস্কার করে দেন এসব।

গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য আম্মাদুল ইসলাম বলেন মায়ের খাবার দেয়া বা ঘরে রাখার মত সক্ষমতা ছেলেদের আছে। তার ছেলে ও নাতী যারা আছে তারা প্রত্যেকে একদিন করে খেতে দিলেও এক সপ্তাহ হয়ে যায়। তবে ওদের বারবার বললেও তারা কারও কথা শোনেন না।

এবিষয়ে ইউএনও’র দায়িত্বপালনকারী সহকারী কমিশনার (ভূমি) কাফী বিন কবির বলেন, এটা খুবই অমানবিক বিষয়। মাকে এভাবে বাঁশঝাড়ে ময়লা আবর্জনার মধ্যে রাখার মত খারাপ অবস্থায় তারা নেই। আমরা তাকে আপাতত কিছু খাবার, হাত খরচ ও দুটি কম্বল দিয়ে ছেলের ঘরে তুলে দিয়ে এসেছি। তার ছেলেদের অফিসে আসতে বলা হয়েছে। তাদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

খুলনা গেজেট/ টি আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন