সাতক্ষীরার দেবহাটা থানা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন আশিক হাসান জুয়েল (৩২)। মাথায় হাতুড়ি জাতীয় ভারী বস্তুর আঘাত ও নাকের উপরিভাগে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ফলে রক্তক্ষরণ ও পরবর্তীতে দেহটি পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়ার কারণে জুয়েলের মৃত্যু হয় বলে ধারণা করছে পুলিশ। বুধবার (২ জুন) রাতে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। এদিকে হত্যাকান্ডের আগে জুয়েলের সঙ্গে দেখা করতে আসা বাইক আরোহী দুই যুবককে খুঁজছে পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেবহাটা পোস্ট অফিস সংলগ্ন এলাকার মৃত আনিছুর রহমানের ছেলে জুয়েল ছিলেন ওই এলাকার অন্যতম ধণাঢ্য পরিবারের সন্তান। বাড়ি, একাধিক পুকুর এবং বাকি অংশে গাছপালা ও ঝোপঝাড় বেষ্টিত প্রায় ৩০ বিঘা সম্পত্তির ভুতুড়ে বসতভিটায় বৃদ্ধ মা ও একমাত্র শিশু ছেলেকে নিয়ে বাস করতেন জুয়েল। সম্পত্তি দেখাশুনা ছাড়া অন্য তেমন কোন পেশা ছিল না তার। দুই ভাইয়ের মধ্যে জুয়েল ছিল ছোট। তার বড় ভাই রাজু দীর্ঘদিন ঢাকায় থাকেন। অঢেল সম্পদের মালিক জুয়েল গেল কয়েক মাস আগে বেশ দামী ব্রান্ডের একটি প্রাইভেট কার কেনেন। যেটি প্রায় তার বাড়ির আঙিনায় রাখতেন তিনি।
বছর খানেক আগে অন্যত্র বিয়ে করে শিশু ছেলে আরিয়ানকে জুয়েলের কাছে রেখে সংসার ছাড়ে তার স্ত্রী। সেই থেকে মনমরা জুয়েল প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বাড়ির আঙিনায় থাকা নিজের প্রাইভেটকারের মধ্যে অথবা বাড়ির পিছনের দিকে পুকুরের সিড়িতে বসে সময় কাটাতেন।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, জুয়েল মাদকাসক্ত ছিলেন। সন্ধ্যার পর ওই প্রাইভেটকারের মধ্যে অথবা পুকুর পাড়ে নির্জনে বসে মাদক সেবন করতো সে। মাদক বিকিকিনির সাথে জড়িত একাধিক ব্যক্তি জুয়েলের বাড়িতে মাদকদ্রব্য পৌঁছে দিতো। মাঝে মধ্যে সন্ধ্যার পর জুয়েলকে সঙ্গ দিতে ওই পুকুর পাড় বা প্রাইভেটকারে আসতো চেনা অচেনা অনেকেই। মায়ের সাথে মনোমালিণ্য থাকায় গেল কয়েক মাস যাবৎ হোটেল থেকেই তিনবেলা খাবার আনিয়ে খেতেন জুয়েল।
বুধবার সন্ধ্যার পর বাড়ির কাজের ছেলেটিকে খাবার আনতে হোটেলে পাঠিয়ে জুয়েল বাড়ির পিছনের পুকুরের সিড়িতে বসে ছিলেন। আর তার শিশু ছেলেকে নিয়ে বৃদ্ধ মা শুয়ে ছিলেন ঘরে। রাত সোয়া ৮ টার দিকে একটি মোটরবাইকে দু’জন ব্যক্তি বাড়িতে ঢুকে জুয়েলকে খোঁজ করে। অন্ধকারে বাইক আরোহীদের না চিনলেও তাদেরকে জুয়েলের সঙ্গী ভেবে পুকুর পাড়ের দিকে যেতে বলেন মা। এরপর তারা দু’জন জুয়েলের খোঁজে পুকুর পাড়ের দিকে চলে গেলে জুয়েলের মা-ও এশার নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েন।
পুলিশের ধারণা ওই সময়েই পুকুরের সিঁড়িতে নৃশংসভাবে জুয়েলকে হত্যা করে তার দেহটি টেনে হিচড়ে নিয়ে অপর পাশের আরেকটি পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। রাত ৯টার পর তাকে খুঁজতে গিয়ে পুকুরের সিঁড়িতে রক্ত পড়ে থাকতে দেখে রক্তের দাগ অনুসরণ করে পুকুরে জুয়েলের লাশ দেখতে পান স্বজনরা। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গায়ে টিশার্ট পরিহিত ও শরীরের নিন্মাংশ বিবস্ত্র অবস্থায় জুয়েলের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
উদ্ধারকালে জুয়েলের জুতো মিললেও তার কাছে থাকা মোবাইল ফোন, পরিহিত লুঙ্গি এমনকি হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের এখনও কোন সন্ধান মেলেনি। অন্যদিকে হত্যার পূর্বমুহূর্তে জুয়েলের কাছে আসা ওই দুই বাইক আরোহী কারা ছিলো এবং নৃশংস এ হত্যাকান্ডের মোটিভ কি সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি জুয়েলের পরিবার ও পুলিশ।
বৃহস্পতিবার একাধিকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করেন সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সজীব খান, দেবহাটা সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এসএম জামিল আহমেদ, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি ইয়াছিন আলম চৌধুরী, দেবহাটা থানার ওসি বিপ্লব কুমার সাহা ও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ফরিদ আহমে।
দেবহাটা সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এসএম জামিল আহমেদ বলেন, হত্যাকান্ডের আগে জুয়েলের কাছে ওই দুই বাইক আরোহীর খোঁজ চলছে। হত্যার মোটিভ ও খুনীদের সনাক্ত করতে আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ অ্যানালাইসিসসহ পুলিশের সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
দেবহাটা থানার ওসি বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, নিহতের লাশ ময়না তদন্ত শেষে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই রাজু বাদি হয়ে বৃহস্পতিবার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ হত্যার মোটিভ উদঘাটন ও হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
খুলনা গেজেট/এনএম