খুলনা, বাংলাদেশ | ২২ আশ্বিন, ১৪৩১ | ৭ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  সামিট গ্রুপের আজিজসহ পরিবারের ১১ সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ
  সামিট গ্রুপের আজিজসহ পরিবারের ১১ সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ
  সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার

মানুষের জন্য রক্ত জোগাড়ে ছুটে বেড়ান তাঁরা

আজিজুর রহমান

বয়স কত হবে-বড়জোর ২২ কি ২৫! সারাক্ষণ অপেক্ষায় থাকেন একটি আহবানের, ‘একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন।’ এমন খবর পেলেই অসুস্থ মানুষের রক্ত জোগাড়ে ছুটে বেড়ান একদল তরুণ। যখন যার প্রয়োজন, তখন তার জন্য রক্ত জোগাড় করে দিচ্ছেন তাঁরা। রাতদিন যেকোনো মুহূর্তে রক্ত সংগৃহীত হয়ে যাচ্ছে। শুধু সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। সংগঠনটির নাম ‘খুলনা ব্লাড ব্যাংক’। সংগঠনের সদস্যরা রোগীর ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে যান হাসপাতালে। রক্ত দিয়ে ফেরেন হাসিমুখে।

খুলনা শহরের একদল তরুণদের এখন এটি মুখ্য কাজ। স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে গড়ে তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রথম দিকে ওই তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) গ্রুপ তৈরি করে এক হয়েছেন। ‘খুলনা ব্লাড ব্যাংক’ নামের ওই গ্রুপের তরুণেরা রক্তদানে সাড়া দিয়ে ছুটে বেড়ান মানুষের জীবন বাঁচাতে। এমনও হয়েছে রোগীর নামধাম জানেন না, রক্ত দিয়ে চলে এসেছেন। এ রকম অনলাইনভিত্তিক একটি সংগঠন দুশ্চিন্তায় ভরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে রক্তদাতা জোগাড় করে তাঁদের শঙ্কা দূর করতে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

খুলনা ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন মো. সালেহ্ উদ্দীন সবুজ শোনান তাঁদের এক হওয়ার পটভূমি। শিক্ষাজীবন শেষে নগরীতে ব্যবসায় শুরু করেন সবুজ। তখন মাথায় জেঁকে বসে খুলনার সংকট নিরসন করে উন্নয়ন সম্ভাবনার কথা। সেভাবেই ২০১৬ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘আমাদের খুলনা’ নামের একটি ফেসবুক পেজ তৈরি করেন। এরপর ফেসবুকে কথাবার্তা। একপর্যায়ে ওই পেজে রক্ত প্রয়োজন দাবি করে মন্তব্য করেন একজন ব্যক্তি। তাতে সাড়া দেন ফারদীন ইসলাম অনিক নামের একজন তরুণ।

সবুজ খুলনা গেজেটকে বললেন, ‘আগে থেকে কারো সঙ্গে সেরকম সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন সময় পেজে রক্ত প্রয়োজন দাবি করে মন্তব্য করেন অনেকেই। এতে সাড়া দিয়ে রক্ত দিতে গিয়ে পরিচয়। তারপরে রক্তদাতাদের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ হতো। একটা সময় চিন্তা করলাম, নিজেদের একটা প্ল্যাটফরম দরকার। এরপর সবার সঙ্গে আলোচনা। অবশেষে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ খুলনা ব্লাড ব্যাংকের যাত্রা শুরু।’

খুলনার রক্তদাতা সংগঠনগুলোর মধ্যে খুলনা ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম বেশি বিস্তৃত। ফেসবুকে এই সংগঠনের অনুসারী (ফলোয়ার) ১০ লাখেরও বেশি। তাঁরা প্রতিদিন গড়ে রক্ত দেন কমপক্ষে ৭০ থেকে ৭৫ ব্যাগ।

খুলনার সবখানে রক্ত দিতে যান? সবুজ বললেন, ‘খুলনা থেকে শুরু করে ঢাকা, রাজশাহী রক্ত দিতে যান আমাদের সদস্যরা। শুধু ঢাকা, রাজশাহী নয় দেশের প্রতিটি জেলায় আমরা রক্ত দিয়ে আসছি। আমাদের অনুসারী (ফলোয়ার) সব জেলায় রয়েছেন। এই কাজে কোনো ছুটির দিন নেই। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই রক্তের চাহিদা থাকে। যখন-তখন ফোন আসে। পালা করে আমাদের কেউ না কেউ সারাক্ষণ অনলাইনে সক্রিয় থাকেন। চাহিদা পাওয়ামাত্রই তা পূরণের জন্য তৎপর হয়ে পড়েন।’

কীভাবে এত চাহিদা সামাল দেন? জানতে চাইলে মুখে হাসি টেনে গ্রুপটির অ্যাডমিনদের মধ্যে অন্যতম একজন মো. আসাদ শেখ বলেন, ‘আমাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা এখন অনেক বেশি। সামাল দেওয়া কঠিন বটে, তবে পারছি তো। কারণ, আমাদের বড় শক্তি অনুসারীরা (ফলোয়ার)। ফেসবুকে রক্তের আহবান পোষ্ট করলেই অনুসারীরা যোগাযোগ শুরু করেন। এরপর আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তদাতা পৌঁছে যান রোগীর কাছে। অবশ্য রোগীর বিস্তারিত জেনে তারপর আমরা উদ্যোগ নিই।’

খুলনা ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন ছয়জন হলেও বর্তমানে ২০ জন রয়েছেন। এরমধ্যে ৫০ বারের ওপরে রক্ত দিয়েছেন সৌরভ গাইন নামের একজন স্বেচ্ছাসেবী।

জানতে চাইলে প্ল্যাটফরমের ফোকল পারসন সৌরভ গাইন খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। এই প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও আমরা মানুষের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ঈদের ছুটিতে মানুষজন স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটান। অনেকে হাসপাতালে অসুস্থ স্বজনকে রেখে বাড়িতে ঈদ করতে চলে যান। আমরা এমন রোগীর পাশে দাঁড়াই। রক্তের ব্যবস্থা করে দিয়ে তাঁর সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি। অনেক সময় গভীর রাতে অনেকে রক্তের জন্য ফোন করেন। তখন রক্তদাতা সংগ্রহ করে দিতে হয়। রক্ত পাওয়ার পর রোগীকে যখন সুস্থ হতে দেখি, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই।’

সংগঠনটি সূত্রে জানা গেছে, ১১৩ জন সহকার্যকরী ও ৫১ জন কার্যকরী সদস্য এবং ৩০ জন মডারেটর রয়েছেন ওই সংগঠনের প্ল্যাটফরমে। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রথমেই সহকার্যকরী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। কর্মদক্ষতায় নির্বাচিত হন কার্যকরী সদস্য। তাঁদের রয়েছে ‘সুপার ডোনার’ নামে রক্তদাতাদের একটি তালিকা। যেখানে ৫০ হাজার সদস্য রয়েছেন। তাঁরা দেশের যেকোনো প্রান্তে গিয়ে রক্ত দিতে প্রস্তুত।

সংগঠনটির রক্তদান করা ছাড়াও শীতবস্ত্র বিতরণ, ব্লাড গ্রুপিং, রক্তদানে উৎসাহিত করা ও থ্যালাসেমিয়া মুক্তির লক্ষ্যে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, অসহায় রোগীদের সাহায্য করা ও অসহায়দের মধ্যে খাদ্য সহায়তা প্রদান।

গ্রুপটির সর্বপ্রথম রক্তদাতা ফারদীন ইসলাম অনিক। ২০১৬ সালের প্রথম দিকের একটি ঘটনা থেকে শুরু হয় রক্তদান। ওই পেজের একজন অনুসারী বজ্রপাতে শরীর পুড়ে গেছে এক নারীর জন্য রক্তের প্রয়োজনে মন্তব্য করেন ডুমুরিয়া থেকে। রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ। অ্যাডমিন অনিকের গ্রুপ সঙ্গে মিলে যায়। একটি কলেজে অধ্যয়নরত অনিক এই ধরনের আহবানের জন্য প্রস্তুতও ছিলেন। খবর পাওয়ার পরপর রওনা হয়ে যান খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পথে। মিনিট বিশেকের মধ্যেই পৌঁছে যান। রক্ত দিয়ে কয়েকমিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ ধরে ফিরে আসেন ঘরে।

ওই নারীর স্বজন সাব্বির আহম্মেদ বললেন, ‘এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও রক্ত জোগাড় করতে পারেনি। আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল খুলনা ব্লাড ব্যাংকের অনিক ভাই।’

বছর তিনেক আগে দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের নবান্ন সরদার নামের এক শিশুর থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়ে। এখন ওই শিশুর বয়স চার বছর। বছরের প্রতিমাসে শিশুটিকে অন্তত এক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। নবান্নর বাবা পেশায় দিনমজুর। রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো ‘মা’ সুলতা সরদার। একদিন খুলনা ব্লাড ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর সব কষ্ট ঘুচে গেছে তাঁর।

সুলতা সরদার খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘খুলনা ব্লাড ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবীরা আমার ছেলেকে রক্ত সংগ্রহ করে দেন। এখন আর আমার ছেলের রক্তের জন্য মানুষের কাছে ঘুরতে হয় না। ব্লাড ব্যাংকে কয়েকদিন আগে জানিয়ে দিলেই রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যায়।’

নবান্নর মতো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত প্রায় ৩৫ জনকে নিয়মিত রক্তের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে খুলনা ব্লাড ব্যাংকের সদস্যরা। অ্যাডমিনরা জানান, রক্তের ব্যবস্থা করেন বিনামূল্যে। গরিব হলে অনেক সময় রক্তের ব্যাগও কিনে দেন। প্রতি মাসে অ্যাডমিনরা জনপ্রতি মাসে এক থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ করেন এই কাজে। এই টাকা তাঁরা খুশি মনে ব্যয় করেন। রক্ত দেওয়ার পর রোগীরর স্বজনদের মুখে যে হাসি দেখেন, তাতে মন ভরে যায়।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চলন বিভাগের প্রধান ও সহকারি অধ্যাপক এসএম তুষার আলম মুঠোফোনে খুলনা গেজেটকে জানান, স্বেচ্ছাসেবী এই রক্তদাতা সংগঠন অসহায় মানুষকে রক্ত দিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছে। শুধু রক্তদান নয়, অনেক ক্ষেত্রে হতদরিদ্রদের ওষুধ কেনাসহ টাকা-পয়সা দিয়ে সহায়তা করছে। তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনের সময় এ সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহজেই রক্ত পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচাতে তরুণদের এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।’

 

খুলনা গেজেট / এআর




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!