খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

বাংলার ছাত্র থেকে যেভাবে দুর্ধর্ষ খুনি হলেন শিমুল ভূঁইয়া

এ এইচ হিমালয়

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনারুল আজিম আনার হত্যাকান্ডে গ্রেপ্তার আমানুল্লাহই খুলনার শীর্ষ চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া। তার পরিবারের একাধিক সদস্য ও পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর নৃশংসভাবে সংসদ সদস্য আনারকে হত্যা এবং লাশ গুমের ভয়ংকর পরিকল্পনায় শিউরে উঠেছেন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা।

তবে এমন ভয়ংকর কাজ এটাই শিমুলের জন্য প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক হত্যা, ডাকাতি বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছেন শিমুল। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নথিতে উঠে এসেছে তার অপরাধ কর্মকান্ডের বর্ণনা।

বাংলার ছাত্র যেভাবে চরমপন্থি নেতা

থ্য অনুযায়ী, চরমপন্থি নেতা ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে মাহমুদ হাসান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ওরফে শিহাব ১৯৭০ সালের ৪ মে খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ক্লার্ক ছিলেন।

শিমুল দামোদর মুক্তময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ, ফুলতলা কলেজ থেকে এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ এবং ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় বাংলা বিষয়ে অনার্স পাশ করেন।

তার ৫ ভাই ও ২ বোন রয়েছে। তারা হলেন বড় ভাই হানিফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে লাকী, মুস্তাক মোহাম্মদ বকুল, মরহুম ওয়াজির মোহাম্মদ মুকুল, শিপলু ভূঁইয়া, ছাদেক মোহাম্মদ, বোন লুচি খানম ও ফারজানা লিপি।

১৯৮৬ সালে শিমুলের বোন লুচি খানমের সঙ্গে তার ফুফাতো ভাই ঝিনাইদহ জেলার কোটচাদপুর উপজেলা সদরের ডা. মিজানুর রহমান টুটুলের বিয়ে হয়। শিমুল তখন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে অনার্সের ছাত্র। আর ডা. টুটুল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা। ওই বছর কাল মার্কস ও চারু মজুমদারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিমুল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। মূলত ডা. টুটুলের পরামর্শ ও দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নাম লেখান চরমপন্থি দলে। ১৯৯১ সালে তাকে খুলনায় পার্টির সদস্য করা হয়।

পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ অঞ্চলের এক সময়ের ভয়ংকর জনযুদ্ধ নেতা আবদুর রশিদ মালিথা ওরফে তপন যখন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বিভাগীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তখন শিমুল ছিলেন ওই কমিটির সম্পাদক।

একের পর হত্যা মিশনে শিমুল

১৯৯১ সালের শেষের দিকে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিমুলসহ ৫ জন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শৈলগাতী বাজারে একটি সশস্ত্র গ্রুপের নেতা এমরান গাজীকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর স্থানীয় লোকজন তাদেরকে ৩টি অস্ত্রসহ আটক করে ডুমুরিয়া থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।
পরে এমরান গাজী হত্যা মামলায় শিমুলের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। ওই মামলায় শিমুল ১৯৯১ সালের ২৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। খুলনার আদালতে তার হাজিরার দিনগুলোতে পার্টির নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে দেখা করে সংবাদ আদান-প্রদান করতো। পরে হাইকোর্টে আপিলের মাধ্যমে হত্যাসহ ৩টি মামলায় জামিনে মুক্তি পান।

শিমুল ১৯৯৬ সালে যশোর কারা বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ ব্যাপারে ১৯৯৬ সালের ২২ ডিসেম্বর যশোর কোতয়ালী থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৪ এপ্রিল তার জামিন হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জামিনের নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হওয়ার পর পুনরায় আর আদালতে হাজিরা না দিয়ে পলাতক ছিলেন।

তিনি ১৯৯৭ সালে যশোর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরে নগরীর বয়রা সিএসডি গোডাউন এলাকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক আবুল কাশেমের মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তাকে বিয়ে করেন।

১৯৯৮ সালের শেষের দিকে পার্টির শীর্ষ নেতারা তাকে যশোর অঞ্চলে কাজ করার দায়িত্ব দেয়।

১৯৯৮ সালের ২ জুন শিমুলসহ ৫/৬ জন দামোদর গ্রামের সেলিম সরদারকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। খবর পেয়ে পুলিশ সেলিমকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ফুলতলা থানায় মামলা এবং পরবর্তীতে পুলিশ তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে।

১৯৯৮ সালের ১১ জুন পুলিশ শিমুলের বাড়ি ঘেরাও করলে শিমুল ও তার সহযোগীরা গুলি চালায়। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয় এবং শিমুল পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় পরদিন তার বিরুদ্ধে মামলা এবং পরে এ মামলায় পুলিশ চার্জশিট দাখিল করে।
১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট দুপুরে ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই দিন শিমুল ও তার ৫ সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ মামলায় পরে শিমুলের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। তবে মামলাটিতে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন।
১৯৯৮ সালের ১১ নভেম্বর শিমুল ও তার সহযোগীরা ফুলতলা বাজারের ব্যবসায়ী ওয়াজেদ মোল্লার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ৯০ হাজার টাকা লুট, গুলি ছোড়ে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় ১৩ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে মামলা এবং পরে পুলিশ চার্জশিট দেয়।

১৯৯৯ সালের ২০ মে রাতে শিমুল ও তার ৮/৯ জন সহযোগী খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেছনে পার্টির সদস্য গণেশকে জবাই করে হত্যা করে। এ ঘটনার পরদিন নগরীর সোনডাঙ্গা থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।

১৯৯৯ সালে সরকার চরমপন্থিদের আত্মসমর্পনের সুযোগ দিলে তার কয়েকজন সহযোগী আত্মসমর্পণ করে, তবে শিমুল তাতে সাড়া দেয়নি। ২০০০ সালের ২৯ মার্চ তার বিরুদ্ধে ডুমুরিয়া থানায় একটি হত্যা ও ১২ মে ফুলতলা থানায় একটি হত্যা চেষ্টা মামলা হয়।

২০০০ সালের ২৫ মে শিমুল পার্টির নেতাদের নিয়ে যশোরে সভা করার জন্য গেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই জামিনে যশোর কারাগার থেকে বেরিয়ে যান। এরপর থেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তিনি।

২০১০ সালের ১৬ আগস্ট নিহত কাশেমের ছেলে ও দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ বাদলকে গুলি করে হত্যা করে। কারাগারে থাকা শিমুলের নির্দেশে তার সহযোগীরা ঘটায় এ হত্যাকান্ড। ফলে মামলার চার্জশিটে তার নাম আসেনি।

২০১৭ সালের ২৫ মে রাতে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুলি করে হত্যা করা হয় ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দিন মিঠুকে।

খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, সরদার আলাউদ্দিন মিঠু হত্যার পর শিমুলকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হয়। দেশে না থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। নতুন কোনো হত্যাকান্ডে শিমুলের নাম আসছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।

 

খুলনা গেজেট/হিমালয়




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!