খুলনা, বাংলাদেশ | ১৩ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনি রোডম্যাপ দেয়ার আহবান বিএনপির: মির্জা ফখরুল
  চলমান ইস্যুতে সবাইকে শান্ত থাকার আহবান প্রধান উপদেষ্টার: প্রেস সচিব
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৮

জরাজীর্ণ কুঠিরে বসবাস তাদের

তরিকুল ইসলাম

“সরকারি রাস্তা তৈরির সময় আমার পৈত্রিক সম্পত্তির ওপর স্থাপিত ভাঙাচুরা ঘরটি সরিয়ে নিতে হয়। তবে ঘর কিংবা জমির কোন ক্ষতি পূরণ পাইনি আজও” – ঝুঁপড়িতে বসবাসকারী আয়শা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বার বার বিধ্বস্ত খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার অসংখ্য পরিবারের বসবাস জরাজীর্ণ কুঠিরে। আয়লা, সিডর, বুলবুল, আম্পান ও সর্বশেষ ইয়াসের তান্ডবে নিঃস্ব হয়েছে বহু পরিবার। কারো জমি চলে গেছে নদীগর্ভে, নোনা পানিতে ভেসে গেছে কারো বাড়ি ঘর। দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আগেই ফের নদীর বাঁধ ভেঙে নোনা পানিতে নষ্ট হয়ে যায় আসবাবপত্র-ঘরবাড়ি, সম্পদসহ জমির ফসল।

নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়া এখানকার মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন কয়েক হাজার পরিবার। প্রায় সাড়ে চার হাজার পরিবারের দুই-চার শতক জমি থাকলেও দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। আবার কেউ সব হারিয়ে এলাকা ছেড়ে অবস্থান করছেন শহরের কোন বস্তিতে। শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) কয়রা উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে সরেজমিন যেয়ে ও খোঁজ নিয়ে এমন চিত্রের দেখা মেলে।

ছবি: উচ্চু স্থানে আয়শা খাতুনের ঘর ছিল। রাস্তা তৈরির পর থেকে পাশে খুপড়ি বেঁধে বসবাস করছে।

আয়শা আক্তার। বয়স ৭৪। জরাজীর্ণ ঘর ও পৈত্রিক জমি গেছে সরকারি রাস্তায়, পাননি ক্ষতিপূরণ। স্বামী মারা যায় দেশ স্বাধীনের পূর্বে। এরপর থেকে বাপের ভিটায় থাকলেও এখন তার অবস্থান রাস্তার পাশের ঝুঁপড়িতে। সেখানেই একা বসবাস করছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। একমাত্র সন্তান পরিবার নিয়ে থাকেন বাগেরহাটের মোংলায়। অসুস্থ শরীরে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের আয়ে কোন রকমে দিনতিপাত করছেন তারা। হাঁস-মুরগী ও ছাগল-ভেড়া পালন করে অভাব-অনাটনের মধ্যে তার সংসার চলে। তবে ঘরের অভাবে সে ব্যবসায়ও ভাটি। নেই কোন শৌচাগার। খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দেয়াড়া গ্রামে তার জীর্ণ কুটিরে যেয়ে এসব তথ্য জানা যায়।

তিনি বলেন, বাপের বাড়ি থেকে ৭ কাঠা জমি পাই। এক কাঠা মাটি ভরাট করে আয়লার আগের বছর নাড়ার (ধানের অবশিষ্টাংশ) ছাউনী দিয়ে একটি ঘর তৈরি করি। আয়লার সময় নোনা পানিতে সেই ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফের ঘর তৈরি করে বেশ কয়েক বছর বসবাস করে আসছিলাম। গেল বছর একটি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য মাটির বড় রাস্তা তৈরির সময় আমার পৈত্রিক সম্পত্তির ওপর স্থাপিত ভাঙাচুরা ঘরটি সরিয়ে নিতে হয়। তবে জমি কিংবা ঘরের কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। তখন ইউএনও স্যার (পূর্বের ইউএনও অনিমেষ বিশ্বাস) কথা দিয়েছিলেন একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিবেন। মাত্র ২/৩টি হাঁস আছে, বাইরে রাখতে হয়। ছাগল-ভেড়া কোন রকমে পাশের ঘরে রাখি। আমি এখানে একটা চৌকির ওপর ঘুমাই আর নিচেই চুলা পেতে রান্না করি।

ঝড়-বৃষ্টিতে কি করেন, জিজ্ঞাসা করতেই কষ্টের হাসি দিয়ে তিনি বলেন, এখন বুড়ো বয়সে তোমরা আমার খোঁজ নিতে এসেছো! গেল বছর ইয়াসের সময় পানি উঠলে রাস্তার ওপর বসবাস করেছি। এখন আর ভয় পাইনা। আতঙ্কেও থাকিনা।

জায়গা ভরাট করে একটি ভালো ঘরের ব্যবস্থা হলে কিছুটা বড় পরিসরে হাঁস-মুরগী ও ছাগল-ভেড়া পালন করে একটু স্বচ্ছলভাবে চলতে পারতো বলে জানান তিনি।

ঝুঁপড়িতে তিন প্রজন্মের নয় সদস্যের বসবাস

একই পরিবারের নয় সদস্যের সকলেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তবে পাননা কোন প্রতিবন্ধী ভাতা। দু’জনের আয়ে ও ভিক্ষা করে খেয়ে না খেয়ে দিন কেটে যায় কোন রকম। নেই মাথা গোঁজার জায়গাটুকুও। ঝুঁপড়ির মধ্যেই রান্নার চুলা। দেখা মেলেনি শৌচাগারের। পেটে ক্ষুধা নিয়ে সরকারি জমিতে ছোট একটি ঝুঁপড়ি বেঁধে মেয়ে-জামাই, সন্তান, নাতি-নাতনি নিয়ে একসাথে থাকেন তিন প্রজন্ম।

একই উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের ফতেকাটি গ্রামস্থ কপোতাক্ষ নদের বাঁধের পাশে এমনি একটি পরিবারের দেখা মেলে। এই পরিবারের কষ্টের গল্প সহায় সম্বলহীন কয়রার সবুর মাথা গোজার ঠাঁই চায়’ শিরোনামে খুলনা গেজেট গেল বছরের ১৪ জানুয়ারি তুলে ধরেন। তবে ২১ মাস সময় অতিবাহিত হলেও সমাধান মেলেনি। সেখানে ৬ বছর ধরে বসবাস করছেন ৬৬ বছরের বৃদ্ধ সবুর শেখ ও ফাতেমা দম্পতি। দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন যেন তাদের কাছে নিতান্তই মরিচিকা।

ফাতেমা বেগম জানান, অভাব অনাটনে জর্জরিত হয়ে স্বামী ও তিন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে কয়রা ছেড়ে শহরে যান। সেখানে মেয়ের বিয়ের পর জামাই মেয়েও থাকতে শুরু করে তার পরিবারে। পরে মেয়ের কোলে একে একে এলো ৩ সন্তান, তারাও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। জীবিকা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে ৬ বছর পূর্বে পুনরায় ফিরে আসে তার জন্মভূমি কয়রাতে। সেই থেকে রাস্তার ধারে ঝুঁপড়ি বেঁধে বসবাস করে আসছে এই পরিবারটি।

ছেলে ও জামাই দিনমজুরীর কাজ করেন। একটা ঘরের আশায় স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ বহু মানুষের শরণাপন্ন হয়েছেন পরিবারটি।

সবুর শেখের জামাই বলেন, আমাদের দুটি ঘর হলে অথবা একটু সরকারি জমি হলে সেখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রায় সবাই ভিক্ষা করে। আমি ও কুটুম (সবুরের ছেলে) শহরে কাজকর্ম করি। এ এলাকার সবাই চেনেন। এজন্য এর আশেপাশে ঘর হলে আমাদের সুবিধা হয়।

দু’যুগ কেটেছে জীর্ণ কুঠিরে

রাস্তার পাশে পলিথিন, খড় আর গোলপাতার ছাউনি মোড়ানো ছোট একটি ঘরে গৃহপালিত প্রাণীর সঙ্গেই বসবাস ভূমিহীন মনোয়ারা বেগম ও তাঁর স্বামীর। শেষ আশ্রয়স্থলটুকুও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে মনোয়ারা বেগমদের জীর্ণ কুঠিরে। এই ঘরেই দুই যুগ কেটে গেছে তাদের। কয়রা উপজেলার ছয় নম্বর কয়রা ওয়াপদার রাস্তার পাশে ঝুঁপড়ি ঘরে বসবাস করে আসছেন অসহায় দারিদ্র এ পরিবারটি। স্বামী শাজাহান ঢালী দীর্ঘদিন অসুস্থ। নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে যে অর্থ উপার্জন করেন তা দিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে চালাচ্ছেন তাদের সংসার। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘আর কত গরীব হলে সরকারি অনুদান পাব বলতি পারো?’

কয়রা উপজেলার কতগুলো পরিবার প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় ঘর পেতে আবেদন করেছেন কিংবা কতগুলো হতদরিদ্র পরিবারের বাসগৃহ জরার্জীণ রয়েছে এটার খোঁজ নিতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে গেলে অপারগতা প্রকাশ করে ভূমি অফিসে খোঁজ নিতে বলেন। পরে ভূমি অফিসে গেলে সেখান থেকে জানানো হয় আবেদনের সংখ্যা জানা নেই। এমনকি উপজেলার ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যাও দিতে পারেননি তারা। তবে ঘরের আবেদনকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে এখনও ১৪৯ জন  প্রকৃত ভূমিহীন পরিবার ঘর পাননি বলে জানানো হয়। পিআইও অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে  তিন ধাপে এ উপজেলার ভূমি ও গৃহহীন (ক-ক্যাটাগরী)  ৯০টি পরিবার ঘর পেয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে আরও বেশ কিছু ঘর দেয়া হয়েছে।

বাগালী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সামাদ গাজী বলেন, উপজেলার মিটিংয়ে বহুবার বলেছি। উপজেলা প্রশাসনের কাছে ঘরের জন্য আবেদন দেয়া হলেও জমা নেননি। আমাদের ইউনিয়নে গুচ্ছগ্রাম থাকায় আর ঘর দেবেন না বলে জানানো হয়েছে। এখনও প্রায় দেড় শতাধিক গৃহহীন এমন পরিবার রয়েছে।

মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, আমাদের ইউনিয়নে ২শ’র বেশি পরিবার রয়েছে যাদের ভালো ঘর নেই। অতি দারিদ্র পর্যায়ের হওয়ায় তারা ঘর বানাতে পারেন না। তাদেরকে ঘর দেওয়ার জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

আরও পড়ুন: সহায় সম্বলহীন কয়রার সবুর মাথা গোজার ঠাঁই চায়

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রোকুনুজ্জামান বলেন, আমি নতুন এসেছি। ‘জমি নেই, ঘর নেই’ এমন স্বল্প কিছু পরিবার এখনও ঘর পাইনি। তারা পর্যায়ক্রমে ঘর বরাদ্দ পাবেন। আর ‘জমি আছে, ঘর নেই’ এটা আগের প্রোগ্রাম ছিল। এখন যাদের কিছুই নেই তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রাস্তা তৈরির সময় অসহায় বৃদ্ধার জমি ও ঘর নষ্টের বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবো।

কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর দেয়া হয়েছে। এখনও প্রায় তিনশ’ ভূমিহীন পরিবার রয়েছে। আর ‘জমি আছে, ঘর নেই’ এমন পরিবার রয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার।

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!