জলবায়ু পরিবর্তন, উজানের পানি প্রবাহ বন্ধ, নদীর তলদেশ উঁচু হওয়া, নদী বা খাল খননের নামে ছোট করে ফেলা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত খননে প্রতি বছর বর্ষ মৌসুমে পানিতে হাবুডুবু খেতে হয় সাতক্ষীরার কয়েক লাখ মানুষের। সাতক্ষীরা শহর ও পার্শ¦বর্তী এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্ধেক সময় পার হতে চললেও এখনো ভালোভাবে কাজ শুরুই করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ ১৬ হাজার টাকার এই প্রকল্পে থাকা জলাবদ্ধতা নিরসনে সহায়ক নয়-এমন দুটি বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ গত অর্থ বছরে শুরু হয়। প্রায় ১০ কোটি টাকার ওই দুটি প্রকল্প স্থানীয় জনগণ ও বিএসএফ’র বাঁধার কারণে বন্ধ হয়ে আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, শুস্ক মৌসুমে এসব কাজ শুরু হলে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে। তবে, স্থানীয় নাগরিক সমাজের বক্তব্য পলি ব্যবস্থাপনা, নদ-নদীর আনমশ:সংযোগ, অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত স্লুইস গেট, পোল্ডারের অভ্যন্তরে থাকা খালগুলো উদ্ধ সহ চিংড়ি ঘেরের অপরিকল্পিত বাঁধ অপসারণের কোন ব্যবস্থা না রাখায় গতানুগতিক এই প্রকল্পের মাধ্যমে সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (এক্সটেনশন)-এর নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বিগত ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পান পরবর্তী ২জুন একনেকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ সদর উপজেলাবাসীর জলাবদ্ধতা নিরসনে জরুরীভাবে ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ ১৬ হাজার টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেন। প্রকল্পের আওতায় সাতক্ষীরা পৌরসভা সদর উপজেলা ও আসপাশের জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১ ও ২ এর আওতায় বেতনা নদী ৪৪ কি: মি: ও মরিচ্চাপ নদীর ৩৭ কি: মি: ড্রেজিং ও পুন:খনন, এই সীমানায় অভ্যন্তরীণ ৮২টি খালের ৩৪৪.২২ কি: মি: পুন:খনন ও সংস্কার, ২১টি ¯øুইসগেট সংস্কার/নির্মাণ, ১১৩.১২ কি: মি: বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার, ৪টি আরসিসি ঘাটলা নির্মাণসহ ১.৭০ কি: মি: ঢাল প্রতিরক্ষার কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, বরাদ্দের টাকা আগামী ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থ বছর পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদী এই প্রকল্প পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের কাজ চলমান থাকবে। বরাদ্দকৃত টাকার মধ্যে ২০-২১ অর্থ বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প শুরু হয়। এরমধ্যে সদরের ফিংড়ী ইউনিয়নের ফিংড়ী, এল্লারচর ও ভোমরা এলাকায় ৯ কিলোমিটার ৪০০ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়। এছাড়া এবছর আরো ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক মোঃ আনিসুর রহিম জানান, জেলা নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এলাকার মানুষকে নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন ও জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষার দাবীতে ১০ হাজার ৮৮৭ জনের গণস্বাক্ষরসহ সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। উক্ত স্মারকলিপি প্রদানকালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল ওইদিন রাতেই জেলা নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দ, সিনিয়র সাংবাদিকবৃন্দ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি জুম কনফারেন্সের আয়োজন করেন। উক্ত জুম কনফারেন্সে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তবনা উপস্থাপন করেন। জেলা প্রশাসক পানি উন্নয়ন বোর্ড গৃহীত ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (এক্সটেনশন)-এর নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প সম্পর্কে নাগরিক কমিটিকে লিখিতভাবে প্রস্তবনা উপস্থাপনের অনুরোধ জানান এবং প্রকল্পের যাবতীয় কাগজপত্র জেলা নাগরিক কমিটির কাছে সরবরাহ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নিদের্শনা দেন।
সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র তাজকীন আহমেদ চিশতী বলেন, জলাবদ্ধতায় পৌরবাসীর বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে পৌরসভার কয়েকটি এলাকায় অস্থায়ীভাবে ১৮টি পাম্প বসিয়ে রাতদিন পানি সেচ দিয়ে জলাবদ্ধতা কমানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে এটি কোন স্থায়ী সমাধান নয়। যতদিন বেতনা মরিচ্চাপ নদীসহ সংযোগ খালগুলো খনন ও সংস্কার করা না হবে, ততদিন জলাবদ্ধতার নিরসন হবে না। তিনি বলেন, আমরা জেনেছি পানি উন্নয়ন বোর্ডে প্রায় ৪৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে। আগামী শুস্ক মৌসুমে কাজ শুরু করে তা যথাযথ তদারকির মাধ্যমে বাস্তবায়ন হলে পৌরসভাসহ আসপাশের জলাবদ্ধতা কমবে। তবে সেই বরাদ্দ কতখানি স্বচ্ছতার সাথে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর আওতায় রয়েছে সদর এবং আশাশুনি উপজেলার কিছু অংশ। সাতক্ষীরা শহরের পশ্চিম পার্শ্বে পাউবো বিভাগ-১ এর আওতায়, আর পূর্ব পার্শ্বে বিভাগ- ২ এর আওতায় ভাগকরা। এই প্রকল্পের আওতায় জেলার দু’টি বড় নদী বেতনা এবং মরিচ্চাপ খনন করা হবে। বেতনা নদীর ৪৪ কিলোমিটার এবং মরিচ্চাপ নদীর ১৭ কিলোমটার পওর বিভাগ-২এর আওতায় বাস্তবায়িত হবে। পাশাপাশি সংযোগ ৮২টি খালের ৬৬টি খাল পওর বিভিাগ-২ এর আওতায় রয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে বরাদ্দের প্রায় দেড় বছরে বেতনা নদীর ১৫কিলোমিটার খনন কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে, আর মরিচ্চাপ নদীর ১৭ কিলোমিটার খননের জন্য দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হয়েছে। শীঘ্রেই খনন কাজ শুরু হবে বলে জানান এই নির্বাহী প্রকৌশলী।
তিনি আরও বলেন, আভ্যন্তরীন খালগুলোর সার্ভে কাজ চলমান রয়েছে। তবে সাতক্ষীরা শহরের জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। গত ১০ বছরে একাধিকবার খননের পরও জলাবদ্ধতা অন্তত দশগুন বেড়েছে। সেক্ষেত্রে ৪৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জনগণ কতটা সুবিধা পাবে এমন প্রশ্নের জবাবে রাশিদুর রহমান বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অবশ্যই জনগণ সুবিধা পাবে। কারণ এ যাবতকাল বড় দু’টি নদীর সাথে সংযোগকৃত খালগুলোর যদি ৫টি খনন করার দরকার হতো, সেখানে খনন হতো দুটি। ফলে বাকি ৩টি খনন না হওয়ায় আশানুরুপ ফল জনগন পাইনি। এবার বড় দুটি নদীসহ ৮২টি খাল একসঙ্গে খনন হলে অবশ্যই জনগণ তার সুফল পাবে এমন আশা প্রকাশ করেছেন এই নির্বাহী প্রকৌশলী।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতা নিরসন ও পানি নিষ্কাশনের জন্য দুটি নদীসহ ছোট বড় ৮২টি খাল খনন অত্যন্ত জরুরী। ৩ বছর মেয়াদী ৪৭৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত বছর ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এবার ৪০ কোটি টাকা এডিবির বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে দরপত্র আহবান করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে ডিজাইন ও স্টিমেট অনুযায়ী যাতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা যেন নিশ্চিত করা হয় সে বিষয়ে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ মনিটরিং করা হচ্ছে এবং এই কাজের অগ্রগতিসহ সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসনের ওয়েব পোর্টালে আপলোড করা হবে। যাতে সাধারণ মানুষসহ গণমাধ্যমকর্মীরা জানতে পারেন সে বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জনগন আশানুরুপ ফল পাবে এবং জেলার দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা দুর হবে বলে আশা প্রকাশ করলেন জেলার শীর্ষ এই কর্মকর্তা।
খুলনা গেজেট/ টি আই