খুলনা, বাংলাদেশ | ১৩ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  জামালপুরে ধান মাড়াই করতে গিয়ে তাঁতী লীগ নেতার মৃত্যু
  দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২
  মানিকগঞ্জের গোলড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গাড়িচাপায় দুই সবজি বিক্রেতা নিহত
  গাজীপুরের শ্রীপুরের একটি বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার

ভাষা আন্দোলনে নারীসমাজের ভূমিকা : একটি বিস্মৃত অধ্যায়

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন, কলকাতা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে বাংলাদেশ অর্জন যদি হয় একটি ইতিহাস তবে সেই শহীদদের একটি বড় অংশ নারী সমাজ। বাংলাদেশ গঠনে মুক্তিযুদ্ধ যদি হয় একটি ইতিহাস তবে তারও ভিত্তি ভাষা আন্দোলন। সেই ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশের নারী সমাজের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

দু:খের বিষয় ভাষা আন্দোলনের নারী সমাজের এই ভূমিকা যেন এক বিস্মৃত অধ্যায়। আমরা কি ভুলে যেতে পারি শহীদ জননী জাহানারা ঈমামকে? স্মৃতির অতল গহ্বর থেকে কি মুছে যাবে ড: হালিমা খাতুন, শরীফা খাতুন, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, হামিদা রহমান, মমতাজ বেগম, রওশনারা, জোবেদা খাতুন, চেমন আরা, সেলিনা বাহার, লায়লা নুর, ড: সাফিয়া খাতুন, ড: সুফিয়া আহমেদের নাম ? এদের নাম ভুলে গেলে তো ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হয়।

প্রথমেই আমরা আসতে পারি রওশনারা বাচ্চুর কথায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। একজন নারী ভাষা সৈনিক হিসাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে তিনি ভাষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে তিনি সামিল হন। পথসভা করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিভিন্ন স্থানে জনমত গঠন করেন। আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ঢাকার বালিকা বিদ্যালয়গুলিতে গিয়ে ছাত্রীদের সংগঠিত করে ঢাকার আমতলায় বিশাল সমাবেশ করেন। নারী মিছিল বের করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল এগিয়ে নিয়ে যান। পুলিশের অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেন ঢাকার এই ভূমিকন্যা।

সিলেটের ভূমিকন্যা ছিলেন জবেদা খাতুন চৌধুরী। সিলেটে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। সিলেটের ছাত্রী ও নারী সমাজকে ভাষা আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য একতাবদ্ধ করেন। সিলেটের বিভিন্ন স্থানে সভা-বৈঠক ও পথসভা করেন। জবেদাকে যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তারা হলেন শাহেরা বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা, সৈয়দা নাজিবুন্নেসা খাতুন, লেখিকা রাবেয়া খাতুন। অথচ তাদের ইতিহাস যেন আজ মরে গেছে।

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ড: সাফিয়া খাতুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেনস ইউনিয়নের ভিপি। নাজিমউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলে তিনি প্রতিবাদী হন। ছাত্রীদের সংগঠিত করে এর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে মিছিল এগিয়ে নিয়ে যান। ঢাকা শহরের মহিলা কলেজ ও‌ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের ভাষার দাবিতে সংগঠিত করেন সাফিয়া খাতুন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার আমতলায় যে মহাসমাবেশ হয়েছিল ভাষার দাবিতে তাতে ছাত্রীদের আনার ক্ষেত্রে সাফিয়া সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আজ সাফিয়া আমাদের কাছে বিস্মৃত ।

লায়লা নুর ছিলেন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপিকা। ভাষা আন্দোলনের জন্য তিনি কারাভোগ করেন। ভাষা আন্দোলনের জন্য তিনি পাকিস্তান পুলিশের নির্যাতন ভোগ করেন। তাই তাকে বলা হয় ভাষা-বিপ্লবী। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচিতে লায়লা নুর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আজ এই বিপ্লবী নারীকে আমরা ভুলতে বসেছি।

ড: সুফিয়া আহমেদ । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রী ছিলেন। পরবর্তীতে হন জাতীয়তাবাদী অধ্যাপিকা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের এক প্রথম সারির লড়াকু নেত্রী। ১৪৪ ধারা ভেঙে তিনি পুলিশকে হতবাক করে দেন। পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাস ও লাঠির আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন। সহ্য করেন পুলিশের নির্যাতন। কারাভোগও করেন। আজ তিনি চলে গেছেন স্মৃতির পাতা থেকে।

মমতাজ বেগম। ঢাকার নারায়ণগঞ্জের ভূমিকন্যা। ভাষা আন্দোলনের এক লড়াকু নেত্রী। পাকিস্তান সরকারের নজরদারি ও সামাজিক বাধাকে উপেক্ষা করে ভাষা আন্দোলনে নিজে সঁপে দেন। ঢাকার শহীদ মিনার ময়দান ভরিয়ে দিতে নারায়ণগঞ্জের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। পাকিস্তান সরকারের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। মাতৃভাষার স্বাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে তিনি স্বামী-সংসার ত্যাগ করেন। আজ আমরা এই সূর্যকন্যাকে ভুলতে বসেছি।

প্রতিভা মুৎসুদ্দি ছিলেন চটগ্রামের ভূমিকন্যা। এখানকার রাউজানের পাহাড়তলি গ্রামে ১৯৩৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে মহম্মদ আলী জিন্নার “উর্দুই হবে একমাত্র পাকিস্তানের‌ রাষ্ট্রভাষা”র বিরুদ্ধে তখন চট্টগ্রামেও এর বিরুদ্ধে বিশাল মিছিল বের হয়। ১৩ বছর বয়সে সেই প্রতিবাদ মিছিলে সামিল হন। তিনি তখন রাউজানের মহমুনি এ্যালোপালি ইনস্টিটিউটের ছাত্রী। পরবর্তীতে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের প্রসারে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। আজ তাদের ইতিহাস বিস্মৃত।

ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাচ্ছে ঢাকর ইডেন কলেজের বীর ছাত্রী মাহবুবা খাতুনের নাম। মুছে যাচ্ছে ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী চট্রগ্রামের ভূমিকন্যা চেমন আরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হালিমা খাতুন, নুরজাহান, নোয়াখালির ফেনির জাহনপুর গ্রামের ভূমিকন্যা শরিফা নাম। আমরা নারীকে অর্ধেক আকাশ বা তিলোত্তমা বলে বিশেষিত করি। অথচ তাদের কীর্তিগুলি ভুলে যাই। ইতিহাস কথা বল।

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।

খুলনা গেজেট /এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!