খুলনা, বাংলাদেশ | ২৬ বৈশাখ, ১৪৩১ | ৯ মে, ২০২৪

Breaking News

  প্রথম ধাপের উপজেলা ভোট শেষ, চলছে গণনা
  উপজেলা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ : রিজভী
  তেঁতুলিয়ার খয়খাটপাড়া সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত

প্রথম মফস্বলের অভিজ্ঞতা

এ এম কামরুল ইসলাম

পুলিশের ভাষায় ‘মফস্বল’ বলতে একটা কথা প্রচলিত আছে। বরিশাল এলাকায় এই কথাটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। থানা সদর থেকে কয়েক দিনের জন্য গাট্টি বোচকা বেঁধে ফোর্স ও অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে কোন নির্দিষ্ট এলাকায় জন্য বেরিয়ে পড়ে, সেখানে গিয়ে সেই এলাকা চৌকিদার, দফাদার, মেম্বার চেয়ারম্যান নিয়ে মামলা তদন্ত করা, এলাকার মুলতবী ওয়ারেন্ট তামিল করা, এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদিকে পুলিশের ভাষায় মফস্বল করা বুঝায়।

আমি তখন দ্বিতীয় দফায় বরিশাল কোতোয়ালি থানায় শেষ ছয় মাসের জন্য শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মরত। ওসি ছিলেন জনাব নূরুল আলম সাহেব। সেকেন্ড অফিসার জনাব রুহুল ইসলাম সাহেব, যার বাড়ি ছিল আমার ডুমুরিয়া থানায়। তাঁরই ব্যাচমেট জনাব হেলাল উদ্দিন ছিলেন একই থানায়। তার বাড়ি ফুলতলা থানায়। হেলাল সাহেব ও রুহুল সাহেব আমাকে ভীষণ আদর করতেন। বিশেষ করে হেলাল সাহেব ছিলেন আমার আত্মার খুব কাছাকাছি । তিনি তখনও বিয়ে করেননি। আমরা একসাথে পুলিশ ক্লাবে থাকতাম। তাঁর ব্যক্তিত্ব আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করতো। তিনিও আমাকে ছোট ভায়ের মতো আদর করতেন। এখন তিনি ও আমি দু’জনেই অবসরপ্রাপ্ত। তারপরও নিয়মিত যোগাযোগ আছে। আমরা দু’জনে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সকল বিষয় এখনও ভাগাভাগি করি।

যাহোক, পুলিশের মফস্বল অভিজ্ঞতা নিয়ে বলছিলাম। আমাকে এবার মফস্বলে যাবার নির্দেশ দেয়া হলো। নির্ধারণ করা হলো বরিশাল কোতোয়ালি থানার সবচেয়ে দূরবর্তী ও নদীপথের ইউনিয়ন। ইউনিয়নের নামটা আমার আজও মনে আছে – চন্দ্রমোহন ।

গাট্টি বোচকা বেঁধে ফোর্স ও অস্ত্র গোলাবারুদসহ প্রস্তুত হলাম। দুর্গম নদীমাতৃক এলাকা বিধায় ফোর্সের সংখ্যা বেশি নেয়া প্রয়োজন। তারপর তখন ছিল সর্বহারা পার্টির চরম দৌরাত্ম। বাবুগঞ্জ ও উজিরপুর থানা এলাকায় আনছার বাহিনীর অস্ত্র লুট হয়েছে কয়েকদিন আগে। এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। এর বেশ কিছু আগে গোসাইরহাট থানা পুলিশের অস্ত্র লুট হয়েছিল। সবকিছু মিলে বরিশাল জেলা তখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

বিকাল বেলায় লঞ্চে করে প্রায় অর্ধেক পথ যাওয়া যাবে। সেখান থেকে ইঞ্জিন বোটে চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের কাছে গিয়ে তারপর কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি। সেই বাড়িতে গিয়ে আস্তানা গেড়ে তারপর চলবে অভিযান। পুলিশের নিরাপত্তার জন্য চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।

জীবনের প্রথম মফস্বলে যাবার সময় সমাগত। আমার সাথে তিন জন কনস্টেবল প্রস্তুত। এমন সময় একজন বয়স্ক কনস্টেবল আমার কানে কানে বললেন, “স্যার, আমাকে নিয়ে চলেন৷ আমি ঐ এলাকা চিনি। আপনি নতুন মানুষ। বিপদ আপদ হলে আমি সামলে নিবো”।

এই কনস্টেবল সাহেবের কথা না বললেই নয়। তাঁর চেহারা আমার চোখে আজও ভাসে। তাঁর কনস্টেবল নং ১১৪। নাম- তোফাজ উদ্দীন। তখন তাঁর চাকরি জীবন শেষের পর্যায়ে। থানায় যত লাশ আসতো তার প্রত্যেকটি পোস্ট মর্টেম করাতেন এই তোফাজ উদ্দীন। মরা পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত লাশ টানাটানিতে তিনি কখনও আপত্তি করতেন না। যেকোন লাশ দেখে তিনি বলে দিতে পারতেন, কোনটা ‘হত্যা’ আর কোনটা ‘আত্মহত্যা’। লাশের সুরোতহাল রিপোর্ট কিভাবে তৈরী করতে হয় তা তিনি আমাকে নিজের হাতে শিখিয়েছিলেন। আমার দেখামতে তিনি লাশের সুরোতহাল তৈরীতে দেশের অন্যতম সেরা কনস্টেবল ছিলেন।

তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘সব মানুষের একদিন মরতে হবে। তাই সকল লাশের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। লাশের যত্ন নিতে হবে’। তিনি সকল বে-ওয়ারিশ লাশের যত্ন সহকারে সৎকার ও দাফন করতেন। তিনি আমাকে সন্তানের মত স্নেহ করে আগলে রাখতেন। আমার প্রথম মফস্বল অভিযানে সেকেন্ড অফিসার রুহুল ইসলাম সাহেবের বদান্যতায় এই কনস্টেবল তোফাজ উদ্দীন সঙ্গী হয়েছিলেন। চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের মুলতবী সকল ওয়ারেন্ট ও মামলার কাগজপত্র আমাকে থানার মুন্সি সাহেব বুঝিয়ে দিলেন।

বিকাল, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। লঞ্চ ও ইঞ্জিন নৌকা ভ্রমণ শেষ করে শুরু হলো পায়ে হাঁটা। উদ্দেশ্য চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি। আমার সাথে থাকা অভিজ্ঞ কনস্টেবল তোফাজ উদ্দীন আগে থেকেই চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি চিনতেন। বয়স বেশি হলেও তাঁর হাঁটায় মোটেই ভাটা পড়েনি। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে যতবার জিজ্ঞেস করেছি – ‘চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি আর কত দূর?’ তিনি বলেছিলেন, “এইতো শুনকি স্যার।”

তাঁর উপর আস্থা হারিয়ে মাঝে দুই একজন পথচারীদের জিজ্ঞেস করলে তারাও বলেছিলেন, “এইতো শুনকি”। সেই থেকে ‘শুনকি’ শব্দটি আমার কানে গেঁথে গিয়েছিল।

অবশেষে পদযাত্রার অবসান হলো। পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি। তখন রাত প্রায় দশটা। অভিজ্ঞ কনস্টেবল তোফাজ উদ্দীনের গলার স্বর শুনে চেয়ারম্যান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে উঠে আসলেন। এতরাতে তাঁকে না জানিয়ে এতগুলো পুলিশ তাঁর বাড়িতে যাওয়ায় তিনি একটুও বিরক্ত হলেন না। বরং তাঁর চোখেমুখে আনন্দের ভাব ফুটে উঠলো। আমাকে দেখে তিনি আরো খুশি হলেন। ইতিপূর্বে এই চেয়ারম্যান সাহেবকে আমি দুই একবার থানায় দেখেছিলাম; কিন্তু পরিচয় হয়নি।

বরিশাল এলাকায় কোন বাড়িতে মেহমান হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ইতিমধ্যে হয়েছে। ঐ এলাকার মানুষ অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। বিশেষ করে পুলিশের কদর অনেক বেশি। তাই ঐ রাতে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের হিড়িক পড়ে গেল। সামান্য সময়ের মধ্যে নানাবিধ খাবার দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করা হলো। আরো কয়েকদিন এই মহান আপ্যায়নে রসনা তৃপ্ত করার জন্য চেয়ারম্যান সাহেবের অগ্রিম দাওয়াতে আমি মুগ্ধ হলাম। তিনি আজকের রাতে মনের মতো খাওয়াতে না পারার জন্য বার বার দুঃখ প্রকাশ করলেন।

খাওয়ার শেষে চেয়ারম্যান সাহেবের কাঠের দোতালা বাড়ির একটি রুমে সুসজ্জিত বিছানায় আমাকে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হলো। আমার সাথে থাকা চারজন কনস্টেবল আজ রাতে শুধু ওয়ারেন্ট তামিলের জন্য বাহিরে যেতে অনুমতি চাইলো। আমি তাতে সম্মত না হয়ে আমিও তাদের সাথে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। সকল কনস্টেবল এক প্রকার অবাক হলো। চেয়ারম্যান সাহেব নিজেও অবাক হলেন। তিনি বললেন, “এ কেমন কথা স্যার। আমি চৌকিদার দফাদার ডেকে এনেছি৷ ওরা সারারাত বড় মিয়াদের সাথে সব ওয়ারেন্টের আসামি ধরে আনবে। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।”

কিন্তু আমার মন সায় দিলো না। রাতে যদি ফোর্সের কোন সমস্যা হয় বা কোন মানুষের সাথে যদি কোন খারাপ ব্যবহার করে তাহলে দায়দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে। তাই চেয়ারম্যান সাহেব ও ফোর্সের প্রবল আপত্তি সত্বেও আমি নিজেই ওয়ারেন্ট তামিলে ফোর্সের সাথে গেলাম।

সারারাত ওয়ারেন্ট তামিল করে ভোর বেলায় ছয়জন ওয়ারেন্টের আসামি ধরে আবার চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি হাজির হলাম। চেয়ারম্যান সাহেব রীতিমতো অবাক হতে লাগলেন। তিনি বললেন, “স্যার এরা সবাই আমার নিজের লোক। আমি ডাকলেই তারা হাজির হতো। এর আগে কয়েকবার থানার দারোগা স্যারেরা এসে তাদের আমার বাড়িতে ডেকেছেন। তারা সবাই দারোগা স্যারদের খুশি করে বাড়িতে ঘুমায়। আপনি যখন কষ্ট করে ধরেই এনেছেন তখন আমার কাছে রেখে যান। আপনাকে একটু বেশি খুশি করবো।”

আমার সাথে থাকা কনস্টেবলরা চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে একমত পোষণ করলো। আমি রীতিমতো থমকে গেলাম। প্রতিমাসে ওয়ারেন্ট তামিল নিয়ে ওসি সাহেব, এসপি সাহেব সকল অফিসারকে কত বকাবকি করেন তা আমি ইতিমধ্যে জেনে গেছি। বিশেষ করে দীর্ঘদিনের লাল কালির ওয়ারেন্ট নিয়ে বেশি বকাবকি করেন। ঐ দিন যেসব ওয়ারেন্টের আসামি ধরা পড়েছিল তার সবকটি ছিল লাল কালির ওয়ারেন্ট। তাই চেয়ারম্যান সাহেব ও কনস্টেবলদের সকল অনুরোধ আমি অগ্রাহ্য করে আসামিদের নিয়ে তখনই বরিশাল ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

চেয়ারম্যান সাহেবের চোখেমুখে বিরক্তির ভাব লক্ষ করা গেল। কনস্টেবল সাহেবরা একই ভাব প্রকাশ করলো। কিন্তু গ্রেপ্তারকৃত ওয়ারেন্টের আসামিদের মধ্যে কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। কারণ তারা এর আগে বহুবার চেয়ারম্যান সাহেবের মাধ্যমে কিছু নগদের বিনিময়ে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে গিয়ে নাক ডেকে ঘুমিয়েছে।

অবস্থা বেগতিক দেখে আমি দেরি না করে আসামিদের নিয়ে নদীর ঘাটের দিকে রওয়ানা হতে কনস্টেবলদের নির্দেশ দিলাম। মনে মনে ভীষণ অসম্মানিত হলেও চেয়ারম্যান সাহেব নাস্তা খাইয়ে ছাড়লেন। আমিও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ও চেয়ারম্যান সাহেবের অনুরোধে নাস্তা খেয়ে আসামি ও ফোর্সসহ নদীর দিকে হাঁটতে থাকলাম।

রাতের সেই ‘শুনকি’ র পথ পায়ে হেটে নদীর পাড়ে হাজির হয়ে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। আসামিদের নিয়ে নৌকায় উঠতে গিয়ে দেখলাম তাদের আত্মীয় স্বজনরা নদীর পাড়ে ভীড় করে কান্নাকাটি করছে। আমি বিবেকের কাছে দংশিত হতে লাগলাম। তবুও আসামিসহ নৌকা ছেড়ে দিয়ে তীর থেকে একটু দূরে যেতেই দেখলাম কাল রাতের সেই পরম সেবা প্রদানকারী চেয়ারম্যান সাহেব নদীর পাড়ে হাজির। তিনি একটি কথাও বললেন না। তাঁর জীবনে দেখা ব্যাতিক্রমী ঘটনা নিয়ে হয়তো তিনি হিসেব মেলাতে চেষ্টা করছিলেন।

নৌকা নদীর মাঝখানে গেলে আমি কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়ে আসামিদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম তাদের বিরুদ্ধে কি কি মামলা, তারা কেন দীর্ঘদিন কোর্টে হাজির হয় না, ইত্যাদি। তারা সবাই জানালো, তাদের বিরুদ্ধে কৃষি ঋণের মামলা। কৃষি ঋণ নিয়ে শোধ দিতে না পারায় ওয়ারেন্ট হয়েছে। আমি ফাইল থেকে ওয়ারেন্টগুলি বের করে দেখি ওরা সত্য কথা বলেছে। আমার মনে ভেসে উঠলো এদেশের শত শত ঋণ খেলাপির ছবি। তারা দেশের কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে রীতিমতো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ সামান্য কয় টাকা কৃষি ঋণ নিয়ে অভাবের তাড়নায় শোধ করতে না পারায় তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হয়েছে ; আর সেই ওয়ারেন্ট তামিল করে আমি বাহবা কুড়াবো। নিকুচি করি এমন বাহবার। পরে যা হবার তাই হবে। আমি আপাততঃ সব আসামি ছেড়ে দিয়ে যাবো, তাতে যা হবার তাই হবে। ওদিকে স্বজনদের হাতে হাতকড়া দেখে নদীর ধারে অপেক্ষমান মানুষের মৃদু দীর্ঘশ্বাসে সকালের মৃদুমন্দ বাতাস ভারী হতে লাগলো। আমি তাদের দিকে এক নজর দেখি আর নৌকার ভিতরে থাকা হাতকড়া পরা মানুষের দিকে তাকাই। আমার মনে নানা প্রশ্ন ভিড় করে। আমার পুলিশি পোশাকের ভেতরের মানুষটির কাছে উত্তর জানতে চাই। এক পর্যায়ে নৌকা ফিরিয়ে আবার ঘাটে ভেড়াতে বললাম।

উপস্থিত চেয়ারম্যান সাহেব ও ধৃত আসামির আত্মীয় স্বজনদের ডেকে একসাথে করে তাদের কথা শুনলাম। তারা প্রত্যেকে অত্যন্ত গরীব। চেয়ারম্যান সাহেব ও আসামির আত্মীয় স্বজনদের একসাথে নিয়ে বললাম – ‘আমি এক শর্তে সব আসামি ছেড়ে দিতে পারি। চেয়ারম্যান সাহেব আগামী দুই তিন দিনের মধ্যে সকল আসামিকে বরিশাল পুলিশ ক্লাবে আমার কাছে হাজির করবেন। আমি তাদের জামিনের ব্যবস্থা করবো। উকিলের খরচ আমি বহন করবো’।

চেয়ারম্যান সাহেবসহ সকলে অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার সাথে থাকা কনস্টেবলরা বিরক্ত হতে লাগলো। সকালবেলায় এই কথাগুলি বললে তাদের পকেটে কিছু নগদ নারায়ণ আসতো সেটা আর হলো না। আসামির আত্মীয় স্বজনরা আমাকে বিশ্বাস করতে সাহস করছিল না। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব অনেক অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি পুলিশের মতিগতি বুঝেন। তাই তিনি সকল আসামি পুলিশ ক্লাবে আমার কাছে হাজির করতে সম্মত হলেন। আমি কোন প্রকার কাগজ কলম ছাড়া সকল আসামি চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে ছেড়ে দিয়ে আমার জীবনের প্রথম মফস্বল অভিযানের অকাল সমাপ্তি টেনে বরিশাল শহরের দিকে রওয়ানা হলাম। সারা নদীপথে আমার সাথে থাকা কনস্টেবলদের মুখে বিরক্তির ছায়া দেখতে পেলাম। তাদের এবারের মফস্বল অভিযান বিফলে গেল।

বিকাল বেলা থানায় না গিয়ে সোজা পুলিশ ক্লাবে গিয়ে ঘুম দিলাম। রাতে থানায় যাবার সাথে সাথে ওসি সাহেব তলব করলেন। ইতিমধ্যে তিনি সকল ওয়ারেন্টের আসামি ছেড়ে দেবার সব খবর পেয়ে গেছেন। আমার সাথে থাকা কনস্টেবলদের মধ্যে কেউ হয়তো সব কথা ওসি সাহেবকে বলে দিয়েছে ৷ আমার সাথে মফস্বলে গিয়ে সবাই অহেতুক কষ্ট পেয়ে নগদ নারায়ণ বঞ্চিত হয়ে ওসি সাহেবের কাছে হয়তো কিছু বাড়িয়ে বলে প্রিয়পাত্র হবার চেষ্টা করেছে।

ওসি সাহেব আমাকে ছেড়ে দেয়া ওয়ারেন্টের আসামিদের নাম ধরে ধরে বললেন, “তুমি গতরাতে মফস্বলে গিয়ে অমুক অমুক আসামি ধরে ছেড়ে দিয়েছো। এজন্য তোমার বিরুদ্ধে এসপি সাহেবের কাছে ও কোর্টে রিপোর্ট দেয়া হবে। তাতে তোমার চাকরি চলে যেতেও পারে”।

আমিও এ ব্যাপারে আইনের বিধান জানি। আইনের দৃষ্টিতে আমি মারাত্মক অপরাধ করেছিলাম। ভয়ে শরীর আড়ষ্ট হয়ে আসছিল। তবুও সাহস করে বললাম, ‘স্যার সকল আসামি যদি কোর্টে হাজির হয় তাহলে কি হবে’?

ওসি সাহেব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, “আসামিরা তোমার দুলাভাই লাগে নাকি। তুমি বরিশালের মানুষ চিনো। সারাজীবন তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন যাও সাসপেন্ড হওয়ার জন্য রেডি হও”।

আমি ওসি সাহেবের রুম থেকে বের হবার আগেই অন্যান্য অফিসারগণ আমার গত রাতের কাহিনী শুনে হাসাহাসি শুরু করেছিলেন। আমি তাদের কাছাকাছি যেতেই তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগলেন। আমি মনের কষ্টে সোজা পুলিশ ক্লাবে চলে গেলাম। রাতে কোনমতে খেয়ে বিছানায় গিয়ে সারারাত নির্ঘুম কাটালাম। মনে মনে ভাবলাম, সারদায় ট্রেনিং এ থাকায় তখন বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারিনি। এখন যদি চাকরি চলে যায় তাহলে পড়াশোনা করে বিসিএস পরীক্ষা দিবো। আল্লাহ সহায় থাকলে এর চেয়ে ভাল কিছু হবে।

নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকালে অফিসে যেতে মন চাচ্ছিলো না। অফিসে গেলে ওসি সাহেবের রক্ত চক্ষু দেখতে হবে ও অন্যান্য অফিসারদের উপহাস সহ্য করতে হবে। এসব ভেবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা করতে থাকলাম। এমন সময় পুলিশ ক্লাবের বাবুর্চি কালু এসে বললো, “স্যার, চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাব আর কয়জন মানু আপনার লগে দেহা হরতে আইচে”।

আমি লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ক্লাবের বারান্দায় গিয়ে সকলকে দেখে এক প্রকার কেঁদে ফেললাম। ওরা আমার বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে কাল বিলম্ব না করে নির্ধারিত দিনের আগেই আমার কাছে হাজির হওয়ায় আমি ওসি সাহেবের সেই কথা মিথ্যা প্রমাণ করলাম। ওসি সাহেব বলেছিলেন, ‘তুমি বরিশালের মানুষ চিনো না। ওরা জীবনেও হাজির হবে না’।

সেদিন আমার মনে হয়েছিল, বিশ্বাস অনেক বড়। মানুষকে সত্যিকার বিশ্বাস করে বিনা স্বার্থে মর্যাদা দিলে তারা বিশ্বাস ভঙ্গ করে না। সেখানে নির্দিষ্ট কোন এলাকা বা নির্দিষ্ট দেশ কোন বিষয় নয়। পৃথিবীর মানুষ বিশ্বাস ভঙ্গ করে ‘আস্থা’র অভাবে। একবার কারো মনে আস্থা অর্জন করতে পারলে মানুষ তার মর্যাদা দেবেই।

আমি বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। থানার অফিসার যদি জানে পুলিশ ক্লাবে হাতের নাগালে ছয়জন লাল কালির ওয়ারেন্টের আসামি ঘুরাঘুরি করছে তাহলে এখনি ধরে নিয়ে ক্রেডিট নিবে। তাই দ্রুত গোসল নাস্তা সেরে আসামি ও চেয়ারম্যান সাহেবকে সাথে করে সোজা কোর্টে গেলাম৷ আমার পরিচিত এডভোকেট দিলীপ বাবুকে সব ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বিনা টাকায় জামিন মুভ করতে রাজি হলেন। তবে জামিনের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না। সুতরাং ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব সালেহ হাসান সাহেবের কাছে হাজির হয়ে তাঁকেও সব খুলে বললাম। আমার চাকরির ক্ষতি হতে পারে শুনে তিনিও আসামিদের জামিন দিতে সম্মত হলেন। সকল আসামি একযোগে হাজির হয়ে জামিন পেয়ে গেল।

আহ্, কী যে শান্তি! আমার চোখের সামনে স্বর্গ নেমে এলো। আমি কোর্ট থেকে রিকল নিয়ে থানায় হাজির হলাম। এ যাত্রায় আমার চাকরি বেঁচে গেল। কিন্তু ওসি সাহেবের আস্থা ফিরে পাওয়া গেল না। তিনি সবার কাছে বললেন, “এসব অফিসার দিয়ে থানা চালানো কঠিন। এরা কোন কাজের না।”

এরপর ঐ আসামিদের সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হয়নি। তবে চেয়ারম্যান সাহেব থানায় এলে মাঝে মাঝে আমাকে খুঁজতেন।

আনন্দ

আমার চাকরি জীবনের প্রথম অবস্থায় একসাথে ছয়জন লাল কালির ওয়ারেন্টের আসামিকে কোর্টে হাজির করানো পুলিশ হিসেবে একটা বড় সাফল্য ছিল। সকল আসামিকে গ্রেপ্তার করার পর ছেড়ে দেবার ঘটনায় চাকরির সমূহ ক্ষতি থেকে বেঁচে যাওয়ায় বেশ ভাল লেগেছিল। সবচেয়ে ভাল লেগেছিল অনেকগুলো অসহায় গরীব মানুষের মুখের হাসি।

বেদনা

আইন ও মানবতা কখনও কখনও পরস্পরের বিরোধী। গরীব অসহায় জেনেও ধৃত ওয়ারেন্টর আসামিদের ছেড়ে দেবার অধিকার আইন আমাকে দেয়নি। চাইলেও কোন পুলিশের পক্ষে এই ধরনের মানবিক কাজ করা আইন বিরোধী। আসামিরা যদি ঐদিন আমার কাছে হাজির না হয়ে পালিয়ে থাকতো বা কয়েকদিন পরে হাজির হতো তাহলে আমার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারতো। এই ঘটনার পর থেকে ঐ ওসি সাহেব আমাকে আর কোনদিন সুনজরে দেখেননি। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)

খুলনা গেজেট / আ হ আ




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!