খুলনা, বাংলাদেশ | ১৯ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২ মে, ২০২৪

Breaking News

  অর্থ আত্মসাৎ মামলায় জামিন পেলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস
  রাজবাড়ীতে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক
  হবিগঞ্জের মাধবপুরে ট্রাক ও প্রাইভেটকারের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলে পাঁচজন নিহত
  ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের
বিশ্ব ডাক দিবস

ডাকঘরের সেকাল-একাল

ড. খ. ম. রেজাউল করিম

আজ ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘বিশ্বাসে একযোগে : নিরাপদ এবং সংযুক্ত ভবিষ্যতের জন্য সহযোগিতা’। বিশ্ব ডাক সংস্থার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে স্মরণ করে প্রতি বছর ৯ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন করা হয়।

জানা যায়, জার্মান ডাক বিভাগের কর্মকর্তা হাইনরিখ ফন স্টিফেন ১৮৬৮ সালে একটি পোস্টাল ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং তা প্রস্তাব আকারে জার্মান সরকারের কাছে পেশ করেন। এ প্রস্তাবের সূত্র ধরে জার্মান সরকারের উৎসাহে ১৮৭৪ সালের ৯ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে ২২টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে গঠিত হয় ইউনির্ভাসেল পোস্টাল ইউনিয়ন (আইপিইউ)। পরবর্তী কালে এ সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে উত্থাপিত একটি প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে ৯ অক্টোবরকে বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৮৪ সালে জার্মানির হামবুর্গ শহরে অনুষ্ঠিত ১৯তম অধিবেশনে নাম পরিবর্তন করে বিশ্ব ডাক দিবস রাখা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সাল ইউনিয়ন অর্থাৎ বিশ্ব ডাক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। এরপর থেকে দেশে প্রতি বছর বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ দিবসের লক্ষ্য হলো প্রতিটি দেশের মধ্যে ডাক আদান-প্রদানকে সহজ ও সমৃদ্ধশালী করা এবং এর মাধ্যমে বিশ্বজনীন পারস্পরিক যোগাযোগ সুসংহত করা।

সভ্যতার শুরুতেই মানুষ যোগাযোগের গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে পেরেছিল। সে সময়ে যোগাযোগের জন্য তারা নানা পন্থা অবলম্বন করতো। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে দূত মারফত রাজস্বের সংবাদ আদান প্রদানের প্রমান পাওয়া যায়। এক সময় কবুতরের মাধ্যমে রাজকীয় পত্র আদান-প্রদান হতো। আবার রাজা-জমিদারগণ বিশেষ দূতের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করতো। এসব দূতেরা বাহন হিসেবে ঘোড়াকে বেছে নিতো। জানা যায়, হেনরি অষ্টম ১৫১৬ সালে রয়্যাল মেইল’ নামে প্রথম পোষ্টাল সার্ভিস চালু করেন। এরপর চার্লস দ্বিতীয় ১৬৬০ সালে প্রথম সাধারণ সাধারণ ডাকঘর চালু করেন। ১৮৩৫ সালে রোল্যান্ড হিল আধুনিক ডাকঘরের ধারণা দিয়ে ‘পোষ্ট অফিস রিফর্ম’ প্রকাশ করেন। পরবর্তী কালে ১৮৪০ সালে ব্রিটেনে ‘ইউনিফর্ম পেনি পোস্ট চালু হয়। এর মাধ্যমে চিঠি পাঠানো আরো দ্রুততর হয়। ১৮৫০ সালে ব্রিটেনে চালু হয় ‘পেনি ব্যাক’ নামে ডাক বাক্স। এরপর ১৬৩৩ সালে বিশ্বে প্রথম সমুদ্র ডাক এবং ১৮৩৮ সালে ঘোড়াগাড়ির ডাক চালু হয়। তবে ১৮৪০ সালে প্রথম স্ট্যাম্প চালু করা হয়। জানা যায় কাগজ আবিষ্কারের পর চিঠি লেখার শুরু থেকে তা আধুনিক যুগেও ছিল জনপ্রিয় মাধ্যম। চিঠির জনপ্রিয়তা কমেছে খুব বেশি বছর হয়নি। সেই সাথে কমেছে ডাকবাক্সের গুরুত্ব। ডাকবাক্স, ডাকঘর, ডাকপিয়ন বা ডাকহরকরা এবং তাদের বিলি করা চিঠি এসব শব্দ আজকের যুগে খুব প্রয়োজনীয় না হলেও এক সময় মানুষের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল।

একটা সময় ছিল, যখন মানুষ ডাকঘরের মাধ্যমে তাদের প্রিয় মানুষদের কাছে চিঠি আদান-প্রদান করে যোগাযোগ রক্ষা করত। ফলে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চিঠি আদান-প্রদানে রানার, ডাক পিয়ন, পোস্টমাস্টারসহ অন্যান্য কর্মচারীরা ব্যস্ত সময় পার করতেন। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে হাতে লেখা চিঠি তার আবেদন হারিয়েছে। চিঠির স্থান দখল করে নিয়েছে ই-মেইল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপ, টেক্সট মেসেজ ইত্যাদি। ১৯৯১ সালের কথা। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে সময় পোস্ট অফিসের মাধ্যমে নিয়মিত আমাদের বাড়িতে এয়ারমেইল বা ডাক বিভাগের খামে চিঠি ও পোস্টকার্ড আসত। তখন গ্রামে মোবাইলের প্রচলন ছিল না। ইন্টারনেটের কথা তো ভাবাই যায় না! অফিস-অদালত, বন্ধুবান্ধব, দূরদূরান্তে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে চিঠি আদান-প্রদানের একমাত্র ভরসা ছিল ডাকঘর এবং এলাকায় সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তি ছিল ডাকপিয়ন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের মাসিক খরচের টাকা বাড়ি থেকে আসত মানি অর্ডারের মাধ্যমে। ফলে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা ডাকপিয়নের অপেক্ষায় থাকতাম। কখন টাকা আসবে? আবাসিক হলে বসবাসরত বন্ধুদের মধ্যে যার টাকা আগে আসতো তার কাছ থেকে অনেক সময় টাকা ধার নিতাম। অনেক ক্ষেত্রে মানি অর্ডার হাতে এলেও ডাকঘরে পর্যাপ্ত টাকার অভাবে ডাকপিওন টাকা বিলি করতে পারতো না। টাকা হাতে পাবার পর আমরা খুশি হয়ে পিওনকে বখশিস দিতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমি নিয়মিত বন্ধুবান্ধবদের চিঠি লিখতাম। আমি মূলত ইংরেজি ভাষা চর্চার জন্য বেশি বেশি চিঠি লিখতাম। আমার কিছু সিনিয়র বন্ধু ছিল যারা আমাকে ইংরেজিতে চিঠি লিখতে উৎসাহিত করতেন। উল্লেখ্য আমার নানা আমাকে পোস্ট কার্ডে ইংরেজিতে চিঠি লিখে পাঠাতো। এছাড়া বিশেষ করে কোনো উৎসব যেমন, ঈদ, পুজা, পহেলা বৈশাখের আগে আমরা বন্ধুবান্ধবীদের কার্ড উপহার হিসেবে পাঠাতাম। সে সময়ে মার্কেটে নানা রঙের বাহারি কার্ড পাওয়া যেত। বিশেষ করে আজাদ প্রোডাক্টস, আইডিয়াল প্রোডাক্টসসহ নানা কোম্পানি এ ধরনের কার্ড তৈরি করে বাজারজাত করত।

ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেলে বন্ধুবান্ধবীদের চিঠি আশায় কারণে অকারণে আমাদের গ্রামের হাটখোলায় অবস্থিত ডাকঘরে গিয়ে খোঁজ নিতাম। ডাকপিওন আলতো হেসে মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিতেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত। সে সময়ে দেশে অনেক কম সংখ্যক ডাকঘর ছিল এবং তার অবস্থান বেশ দূরে দূরে ছিল। আমাদের গ্রামে ডাকঘর ছিল বলে গর্ব করে বন্ধুদের বলতাম আমাদের গ্রামে ডাকঘর আছে। তোদের গ্রামে কি ডাকঘর আছে? ডাকঘর থাকা গ্রামকে সমাজে অনেকটা অভিজাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হতো। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে যে সব গ্রামে ডাকঘর ছিল না সেসব গ্রামে চিঠি বিলি করতে ডাকপিওনের অনেক দেরি হয়ে যেত। এসব গ্রামে সাধারণত হাটবারে চিঠি বিলি করা হতো। ডাকপিয়ন হাটে গিয়ে চিঠির প্রাপককে খুঁজতো, প্রাপককে পাওয়া না গেলে গ্রামের অন্য কোনো ব্যক্তি কিংবা ওই গ্রামের কোনো দোকানদারের হাতে চিঠি দেয়া হতো। তিনি প্রাপককে চিঠি পৌঁছে দিতেন। এতে প্রাপকের হাতে চিঠি পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যেত। অনেক সময় দেখা যেত যে প্রয়োজনে চিঠি লেখা হয়েছে তার আর কোনো দরকার নেই। এভাবে সে সময়ে ডাকঘর প্রত্যন্ত অঞ্চলে সামাজিক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল। সে সময়ে দেশে শিক্ষার হার কম থাকার কারণে গ্রামের অনেক অল্পশিক্ষিত মানুষ অন্যের চিঠি লিখে দিত। অনেকে এই চিঠি লেখাকে পেশা হিসেবে নিত। গ্রাম ও শহরের ডাকঘরের সামনে পেশাদার লেখকরা বসে থাকতো চিঠি লেখার জন্য। আমার বাবা পেশায় স্কুল শিক্ষক ছিলেন। সঙ্গত কারণেই গ্রামের অনেক অশিক্ষিত মানুষ প্রয়োজনে তার কাছে চিঠি বা চাকরির আবেদন লেখার জন্য আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আসতো। আমি নিজেও স্কুল ও কলেজে পড়াকালীন এ রকম অনেককে চিঠি লিখে দিয়েছি। সে সময়ে কাজটি করে খুব আনন্দ পেতাম।

বাংলাদেশে এখন ডাকঘরের সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার আর এর গমনপথ ৫০ হাজার কিলোমিটার। হিসেব অনুযায়ী দেশে সাড়ে ১৩ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে একটি ডাকঘর। সাধারণত প্রতিটি ডাকঘরে পোস্ট মাস্টারসহ তিনজন কর্মী থাকেন। ডাক বিভাগের মাধ্যমে মানুষ সঞ্চয়পত্র, ডাক জীবনবীমা, মোবাইল মানি অর্ডারের সেবা পেয়ে থাকলেও সব ডাকঘরে এই সেবাগুলো এখনো পোঁছায়নি। এর মূল কারণ অনুন্নত অবকাঠামো, সেবার সহজলভ্যতা ও ডাকসেবা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতার অভাব। ফলে মোবাইল ব্যাংকিং, বিকাশ, রকেট সার্ভিস চালু হওয়ায় মানি অর্ডারের পরিমাণ কমে গেছে। সুন্দরবন, এসএ পরিবহন, কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সর্ভিস দখল করে নিয়েছে ডাক বিভাগের পার্সেল, চিঠি আদান-প্রদানের স্থান। তবুও কালের ঐতিহ্য হিসেবে টিকে আছে আমাদের ডাকঘর। বাইরের দেশে সব ধরনের ইউটিলিটি সেবা ডাক বিভাগের মাধ্যমে হয়, যা বাংলাদেশে নেই। সে লক্ষ্যে ডাক পরিসেবার মান ও কার্য পরিধি বৃদ্ধি করে ও এটি যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা দরকার। যাতে তা আধুনিকায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারে। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ডাক বিভাগকে টিকিয়ে রাখা দরকার, কাজের গতি বৃদ্ধি করা এবং ঐতিহ্য বজায় রাখা আজ সময়ের দাবি।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসুদন কলেজ, যশোর।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!