দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ একর কৃষি জমি রক্ষার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় খুলনা প্রেসক্লাবে পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ এ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের সভাপতি এড. কুদরত ই খুদা।
লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, দেশের অন্যান্য জেলার মতো উপকূলীয় জেলা খুলনা একটি কৃষি প্রধান জেলা। এ জেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভর করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে থাকে এবং কৃষিই তাদেরবেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
গত ২০২০ সালে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পশুর নদী ড্রেজিং সংক্রান্ত ‘মোংলা বন্দর ইনারবারড্রেজিং’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের অধীন পশুর নদীর ড্রেজিংকৃত বালুমাটি ফেলার জন্য ১০০০ একর জমি হুকুমদখলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যার মধ্যে বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের ৭০০ একর জমি সরকারীভাবেহুকুম দখলের মাধ্যমে বালুমাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে এবং এর মধ্যে প্রায় ৪০০ একর জমিতে বালু ফেলা সম্পন্ন হয়েছে এবং খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলাধীন বানিশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ একর কৃষি জমিতে বালু ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে খুলনা জেলা প্রশাসন থেকে বানিশান্তা এলাকার ২৫০ জন কৃষি জমির মালিককে হুকুম দখলের নোটিশ প্রদান করার প্রক্রিয়া শুরু হলে কৃষিজমির মালিকগণ আপত্তি জানিয়ে এবং তাদের জমিতে বালুমাটি না ফেলার অনুরোধ জানিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু খুলনা জেলা প্রশাসন অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য গণশুনানীর আয়োজন করলেও সেখানে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের সকল মতামত উপেক্ষা করে মোংলা বন্দরের অনুকূলে বানিশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ একর কৃষি জমি হুকুম দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সম্মেলনে আরো উল্লেখ করা হয়, বানিশান্তা এলাকার তিন ফসলি কৃষি জমিকে অকৃষি এবং অনুর্বর দেখিয়ে তা জনমত যাচাই ছাড়াই হুকুম দখল করে মাটি ভরাট করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে দেখা গেছে যে, বানিশান্তার প্রস্তাবিত ৩০০ একর জমি উর্বর তিন ফসলী কৃষিজমি। বানিশান্তার কৃষি জমিতে আষাঢ় থেকে পৌষ মাসে আমন ধান, পৌষ থেকে বৈশাখ মাসে তরমুজ, বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আউশ ধান ও অন্যান্য রবিশস্য চাষ করা হয়।
মাটি ফেলার জন্য প্রস্তাবিত জমিতে শুধু শস্য চাষই নয় একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এলাকার প্রান্তিক মানুষদের জীবন-জীবিকার অন্যতম সংস্থান পুকুর, জলাশয়, মৎস্য সম্পদ ও গবাদি প্রাণী। ফলে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হবে অন্তত ১৫০০ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সনাতনী ধর্মের পরিবার। হুকুম দখলের স্বপক্ষে ছাড়পত্র অনুমোদন নেয়ার ক্ষেত্রে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ অসত্য তথ্যের আশ্রয় নিয়েছে।
বানিশান্তার মাটি অনুর্বর এবং এই মাটিতে নিয়মিত ফসল হয় না বলে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা বিভ্রান্তিকর। বানিশান্তার কৃষিজমিকে সুরক্ষিত রাখতে সরকার বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বানিশান্তাসহ ৩৩ নাম্বার পোল্ডারে ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ থেকে কোস্টাল এমবেকমেন্ট ইরিগেশন প্রকল্পের আওতায় বাঁধ দিয়েছে সেখানকার কৃষি ব্যবস্থা উন্নততর করবার উদ্দেশ্যে।
তারই ধারাবাহিকতায় বানিশান্তায় এখন তিন ফসল আবাদ হচ্ছে। ফলে, বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কৃষিজমিতে মাটি ফেলার এমন অবিবেচক সিদ্ধান্তেরপ্রেক্ষিতে এলাকার জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এলাকাবাসী তাদের এই কৃষি জমি রক্ষায় বিকল্পজায়গা হিসেবে মোংলার কাইনমারি মৌজা, খানজাহান আলী বিমানবন্দরের প্রস্তাবিত এলাকা, খুলনা থেকে মোংলা ছয়-লেনের প্রস্তাবিত রাস্তা, জয়মনি চিলা এলাকাায় যেখানে মাটি ভরাট হয়েছে সেখানে আরো জমি বৃদ্ধি করে মাটি ফেলার বিকল্প জায়গার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে করে একদিকে যেমন বানিশান্তার কৃষিজমি রক্ষা পাবে অন্যদিকে তেমনি সরকারের প্রদেয় হুকুম দখলের ক্ষতিপূরণের টাকা এবং অন্য প্রকল্পে মাটি কেনার টাকা বেঁচে যাবে। এসব বিবেচনায় এলাকাবাসীর পক্ষে বিকল্প জায়গার প্রস্তাবনা করা হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্তে এখনো পর্যন্ত অটল আছে। যার প্রেক্ষিতে আমরা বানিশান্তার তিন ফসলী উর্বর কৃষিজমি, কৃষি ব্যবস্থা, প্রাণ ও প্রকৃতি বাঁচাতে এবং এই এলাকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুজনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে।বন্দর কর্তৃপক্ষ দুই বছরের জন্য উর্বর কৃষিজমি হুকুম দখলের প্রস্তাব করলেও বাস্তবতা হচ্ছে মাটি ভরাটের পর এই জমি আরকোন কৃষি কাজের উপযোগী থাকবে না।
ড্রেজিংকৃত মাটিপলি মাটি এবং তা বানিশান্তার হুকুমদখলকৃত জমিতে ফেললে সেজমি উর্বর হবে এবং কৃষক সে মাটি বিক্রি করে লাভবান হবে এমন দাবি সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। এইসকল অপপ্রচার মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়। মাঠ পর্যায়ে তারজীবন্ত প্রমাণ রয়েছে।
গত ২০১১ এবং ২০২১ এ চিলাতে ফেলা মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ফেলা নদী ড্রেজিং এর মাটিতে ফসলতো দূরে থাক, এমনকি কোন আগাছাও হয়নি। চিলার মত বানিশান্তাতেও মাটি ফেললে এলাকার জনগোষ্ঠী জীবন ও জীবিকাহারিয়ে স্থানান্তরে বাধ্য হবে যা অসাংবিধানিক ও অসংবেদনশীল।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বেলার বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল, নিজেরা করি স্বপন কুমার দাস, ব্লাষ্টের সমন্বয়কারী এড. অশোক কুমার সাহা, টিআইবির ফিরোজ আহমেদ, ব্র্যাকের আবু সাঈদ, বাপার সমন্বয়কারী এড. বাবুল হাওলাদার, সুজনের বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাসুদুর রহমান রঞ্জু, পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের সাঃ সম্পাদক সুতপা বেদজ্ঞ, এড. জাহাঙ্গীর আলম সিদ্দিকী, এড. তসলিমা খাতুন ছন্দা, অজান্তা দাস, আফজাল হোসেন রাজু, খলিলুর রহমান সুমন, এড. সুপ্রিয় রায়সহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ।
খুলনা গেজেট/এসজেড