‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি না, আমার আইডি’র পাসওয়ার্ড…, এটা দিয়ে আইডি খুলে তোমরা কাজ করতে পারবা, আমি যে আইডি কিনছি ওটা বিক্রি করে টাকাটা ফিরিয়ে দিও।’ কথাগুলো চিরকুটে লিখে নাইলনের নেট গলায় বেঁধে তা শোবার ঘরের আড়ার সাথে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছে আশিক রহমান।
গত রোববার দুপুরের দিকে শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের পাঁচশত বিঘা গ্রামে ঘটনাটি ঘটে। সে ছিল একই গ্রামের বাবুর আলী মল্লিক ও খাদিজা আক্তার দম্পতির বড় ছেলে। পাতড়াখোলা আরশাদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র আশিকের পিতা কর্মস্থল সূত্রে কয়েক বছর ধরে ওমানে অবস্থান করছে।
আশিকের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, জমানো টাকা দিয়ে রোজার মধ্যে আশিক ফ্রি ফায়ার গেমস এর আইডি খোলাসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের পাশাপাশি একটি স্মার্ট ফোন ক্রয় করে। এর আগে ফ্রি ফায়ার গেমস এর প্রতি প্রভাবিত হয়ে নানা অজুহাতে মায়ের নিকট থেকে টাকা আদায় করতো সে। এমনকি একজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়লেও মিথ্যে বলে মায়ের থেকে দুইজন শিক্ষকের বেতন আদায় করে আশিক।
তারা আরও জানায়, আত্মহত্যার আগে আশিক ছোট চিরকুটে ওইসব কথার পাশাপাশি পাসওয়ার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে আইডিতে প্রবেশের জন্য ছবিও অংকন করে দেয়। ছোট ভাইকে নিয়ে মায়ের নানার বাড়িতে অবস্থানের সুযোগে সে আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটায়।
জানা গেছে, পরিবারের সদস্যদের লুকিয়ে নির্জন এলাকায় আবার কখনও কখনও ঘরের দরজা আটকে ভিতরে বসে সে ওই গেম খেলতো আশিক। সম্প্রতি অজ্ঞাত কোন কারণে তার আইডি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সে নুতন একটি আইডি খোলাসহ আনুষঙ্গিক খরচ যোগাতে বিচলিত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে কয়েক মাস ধরে কাজ শিখতে যাওয়া মানিকখালী বাজারের ইলেকট্রনিক্সের দোকানের ক্যাশ থেকে তিন হাজার টাকা নেয়।
আরও জানা গেছে, কর্মস্থল থেকে গোপনে নেয়া টাকা দিয়ে নুতন আইডি খোলাসহ ডাটা ক্রয়ের কাজে ২৪০০ টাকা ব্যবহার করে সে। এদিকে ক্যাশে তিন হাজার টাকা কম পড়ার বিষয়টি আরও তিন শিক্ষানবীশ কর্মচারীর মতো আশিকের পরিবারকে জানায় ওই ব্যবসায়ী।
নিহতের চাচা বাবলু মল্লিক জানান, দোকানের ক্যাশ থেকে টাকা খোয়া যাওয়ার বিষয়টি মালিক আব্দুল করিমের মুখে শুনে তার বড় চাচা আশিকের সাথে কথা বলে। এসময় কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সে টাকা নেয়ার ঘটনা স্বীকার করে উদ্বৃত্ত ৬০০ টাকা তাদেরকে ফেরত দেয়। এমনকি নুতন আইডি খোলাসহ ডাটা ক্রয়ের কাজে ২৪০০ টাকা ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
তিনি আরও জানান, টাকা ও ফোনসহ খেলার যাবতীয় সরঞ্জাম তার বড় চাচাকে দিয়ে আশিক বাইরে চলে যায়। দুপুরের দিকে ভাত খাওয়ার জন্য ডাকাডাকির এক পর্যায়ে শোবার ঘরের আড়ার সাথে তার মৃতদেহ ঝুলতে দেখে পরিবারের সদস্যরা।
আশিকের মা খাদিজা আক্তার জানান, গেমসের প্রতি তীব্র আসক্তির কারণে তার ছেলের অকাল মৃত্যু হয়েছে। আশিকের লুকিয়ে মোবাইল ব্যবহারের বিষয়টি জানতে পেরে কয়েকদিন নিজের হেফাজতে ফোন রাখার সময়ে সে উম্মাদের মতো আচরণ শুরু করে। এক পর্যায়ে তার পিতার অনুরোধে ঠিকমত পড়ালেখাসহ কাজ করার শর্তে আবারও ফোনটি তাকে দেয়া হয়। আইডি নষ্ট হলে নতুন আইডি খোলাসহ ডাটা কিনতে কর্মস্থল থেকে টাকা সরিযে ‘চুরি’ অপবাদ সইতে না পেরে সে আত্মহত্যা করেছে বলেও জানান তিনি।
খাদিজা আক্তার আরও বলেন, এ ধরনের ভিডিও গেমস আরও আগে বন্ধ করা হলে আশিককে হারাতে হতো না। বিদ্যালয় বন্ধ থাকার সুযোগে অলস সময় কাটানোর ফাঁকে পড়ে সে ভিডিও গেমস এ আসক্ত হয়ে পড়ে বলেও দাবি তার।
স্থানীয় ইউপি সদস্য সাইদুল ইসলাম জানান, পড়ালেখাসহ বাড়ির কাজে আশিক অনেক মনোযোগী ছেলে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ভিডিও গেমসের সাথে জড়িত হওয়ার পর থেকে লেখাপড়াসহ সব কাজে মনোযোগ হারাতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ভিডিও গেমস নিয়ে দুর্ঘটনার জেরে অকালে তার মৃত্যু হলো।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হুদা জানান, ঘটনার পরপরই পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্ত শেষ হলে পরিবারের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়।
এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ভিডিও গেমস সামাজিকীকরণের পথে বড় অন্তরায়। বিষয়টি শিশুদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রেও অন্তরায়। এসবের প্রতি আসক্তিতে তাদের মেজাজ খিটখিটে হড়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, যে শিশু চুরির অপবাদ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে সে অত্যন্ত ব্যক্তিত্ত্ব সম্পন্ন ছিল। কিন্তু ভিডিও গেমস এর প্রতি মোহ তাকে স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করতে উৎসাহিত করে। মৃত্যুর আগে ছবি এঁকে আইডিতে প্রবেশের নির্দেশনা দিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে শিশুটি ভিডিও গেমসকে তার জীবনের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল।
খুলনা গেজেট/এনএম