খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ভারত থেকে খুলনায় আসেন। পাকিস্তান আমল এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ঈদের স্মৃতি এখনো তাঁর মনে জ্বলজ্বল করছে।
এখনকার সময়ের সঙ্গে ওই সময়ের ঈদের তুলনা টানতে গিয়ে মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, তখনো সার্কিট হাউসে ঈদের প্রধান জামাত হতো। তবে তখন এখনকার মতো উপচে পড়া ভিড় হতো না। এখন জমকালো তোরণ, প্যান্ডেল, সিটি করপোরেশনের বড় আয়োজন এসব আগে ছিল না। তখন নামাজ পড়ত, মানুষ কোলাকুলি ও কুশল বিনিময় করে চলে আসত। এখন তো অনেক কিছু, তবে কিছুটা আর্টিফিশিয়াল হয়ে গেছে।
ওই সময়ের ঈদের দিনের কথা বলতে গিয়ে মাজহারুল হান্নান বলেন, ‘বন্ধুরা দু-তিন আগে বলে রাখতাম, বড় মাঠে (সার্কিট হাউস) নামাজে যেতে হবে। ঈদের নামাজ শেষে ওখান থেকেই আমরা বন্ধুদের বাড়ি যেতাম। এখন পুনর্মিলনী, ঈদ মেলা এটা-ওটা হয়। আগে গ্রামে কিছু কিছু জায়গায় ঈদ উপলক্ষে মেলা হতো। শহরে মেলা দেখিনি।’
ঈদের দিনের ঘোরাঘুরি সম্পর্কে মাজহারুল হান্নান বলেন, ‘বেড়ানো আর খাওয়াদাওয়াই ছিল ঈদের সবকিছু। ছোটরা বন্ধুর বাড়ি আর বড়রা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেশি যেত। কিছু কিছু বাছাই করা আত্মীয়ের বাসায় আমরা ছোটরা যেতাম। সালাম করলে দু-চার আনা সালামি পাওয়া যেত। তাতে খুব খুশি হতাম। কোনো কোনো ঈদে আমরা জেলখানা ঘাটের খেয়া পার হয়ে সেনের বাজারের দিকে যেতাম। নদীর ওপারে যাওয়া ছিল রোমাঞ্চকর। আর সামাজিক বন্ধন বেশি থাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানোটা বেশি ছিল। ঈদের দিন মানুষ পার্কে সময় কাটাতে তেমন যেত না।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, তখন ঈদের দিনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল হলে সিনেমা দেখা। হলে কলকাতা এবং পাকিস্তানের সিনেমা মুক্তি পেত। হলের সামনে লম্বা লাইন পড়ত। টিকিট পাওয়া ভীষণ কষ্টসাধ্য ছিল। টিকিট কালোবাজারিও হতো। একটা শ্রেণির লোক ছিল, যাদের কাছে ঈদের দিন সিনেমা না দেখতে পারলে ঈদটা বৃথা গেল অনুভূতি হতো।
আলাপে আলাপে মাজহারুল হান্নান বলেন, এখন পয়সার আধিক্য হয়েছে। জৌলুশ বেড়েছে অনেক। তখন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এত ছিল না। প্রতি ঘর কমবেশি একরকম ছিল। সমাজব্যবস্থাটা অভিভাবকনির্ভর ছিল। অভিভাবকেরা যেটা দিতেন, তাই পরতে হতো। আবদার করার খুব বেশি সুযোগ ছিল না। তবে জুতা-স্যান্ডেল সব ঈদে না পাওয়া গেলেও নতুন পোশাক পাওয়া যেত। তৈরি পোশাকের (রেডিমেট) তখন আধিপত্য ছিল না। মাপ দিতে যেত হতো দরজির কাছে। শেরওয়ানির চল ছিল, তবে সাদা পাঞ্জাবিও অনেকে পরতেন।
খুলনার প্রবীণ প্রজন্মের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের দিন নারীরা তেমন বের হতেন না। কিশোরীরা অনেকে অভিভাবকের সঙ্গে, কখনো কয়েকজন বান্ধবী মিলে আশপাশের বাড়িতে যেত; তবে তা ছিল হাতে গোনা। তখন ঈদের দিন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা সব বাড়িতেই হতো। মেহমান আসছে-যাচ্ছে। ঈদের দিন হেঁশেল সামলেই দিন পার হতো নারীদের।
খুলনা গেজেট/এএজে