খুলনা, বাংলাদেশ | ২৫ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১০ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  রিসেট বাটন বলতে ৭১ এর গর্বিত ইতিহাস নয় দূর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতি মুছে নতুন সূচনার কথা বলেছেন ড. ইউনূস : প্রেস উইং
  পিরোজপুরে প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে পড়ে শিশুসহ ৮ জন নিহত

মহানগরীর পানি সমস্যা ও ময়ূর নদ ব্যবস্থাপনায় ১১ দাবি

নিজস্ব প্রতি‌বেদক

খুলনা মহানগরীর পানি সমস্যা ও ময়ূর নদ ব্যবস্থাপনা ১১ দফা দাবিতে পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ খুলনা শনিবার সকাল ১১টায় খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক সুতপা বেদজ্ঞ।

লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, খুলনা মহানগরের সুপেয় পানির উৎস ও প্রাপ্যতা সম্পর্কে নগরবাসী মোটামুটি ওয়াকিবহাল। ১৫/১৬ লাখ নগরবাসীর জন্যে প্রয়োজনীয় পানি বিশেষত: সুপেয় পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। শুষ্ক মওসূমে বছরের ফেব্রুয়ারি মাস হতে মে মাস পর্যন্ত এই সমস্যা ভয়ানক রূপে দেখা দেয়। যদি বৃষ্টি দেরিতে আসে তবে সমস্যাকাল দীর্ঘায়িত হয়। পৌর সভা হতে সিটি কর্পোরেশন এবং পরবর্তীতে খুলনা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হলে নগরবাসী স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিল, পানি সমস্যা সমাধান হবে। বিশেষ করে, মধুমতি হতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি এনে নগরবাসীকে সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়ে অনেক আশাবাদ প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে দেখা গেল, ওই প্রকল্প নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি, উপরন্তু নরগরবাসীকে নোনা ও ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। অথচ ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে (ফিজিবিলিটি স্টাডিরিপোর্ট) বছরের এপ্রিল -মে মাসে পানিতে নোনা উপস্থিতির কথা বলা হয়েছিল। বছর দশেকের ব্যবধানে ওই নোনার মাত্রা অনেক বেড়েছে। ওই প্রকল্পের আর একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা, কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনও করতে পারেনি।

সম্মেলনে আরও উল্লেখ্য করা হয়, সামর্থ্যবান নগরবাসী এখন নিজেরা নিজেদের উদ্যোগে সাব-মার্সিবল পাম্প বসিয়ে পানি সমস্যার সমাধান করছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নামছে। এ বছর পানি দিবসের মূল বক্তব্যও ছিল ভূগর্ভস্থ পানি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। দু:খজনক হলেও সত্যি যে, গভীর নলকূপ-এর সাথে সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোর প্রক্রিয়া বেড়েই চলেছে। নগরীতে অপরিকল্পিত ভাবে বিকাশমান আবাসন প্রকল্প এবং নগরীতে অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজের জন্যও অব্যাহত ভাবে সাব-মার্সিবল পাম্পের ব্যবহার বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ভূ-গর্ভের পানির স্তর ইতোমধ্যে কোথাও কোথাও ২৫ থেকে ৩০ ফুটনীচে নেমে গেছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ভূ-গর্ভস্থ পানির আধার টিকিয়ে রাখা এবং পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া রোধ করতে প্রয়োজন পানির রি-চার্জিং (পুনর্ভরণ) ব্যবস্থা বজায় রাখা। বৃষ্টি হলেই রি-চার্জিং-এর সুযোগ সৃষ্টি হয়; আর এই ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন ভূ-উপরি ভাগে যথেষ্ট সংখ্যায় জলাধার সংরক্ষণ করা। দু:খজনক ভাবে খুলনা শহরের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক মালিকানার পুকুরগুলোর হাতে গোনা দু-একটি মাত্র টিকে আছে। নগরীর পূবপাশে আছে প্রবহমান ভৈরব ও রূপসা নদী। পশ্চিম পাশে আছে প্রায় বদ্ধ ময়ূর নদ। এই নদটি দখল-দূষণের দাপট ও প্রবাহনা থাকায় শুকিয়ে মরতে বসেছে।

এর কারণ গুলো হচ্ছে : নদের উপর অপরিকল্পিত বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করা, সংযোগ খালগুলো দখল করে আবাসন প্রকল্প তৈরি করা, সংযোগ খালগুলো এই নদটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং খালগুলোর শ্রেণী পরিবর্তন (জলমহালের স্থানে কৃষি/ডাঙ্গাজমি দেখানো) করে প্রকল্পে ব্যবহার করা, উজানের সাথে সংযোগ বিহীন/প্রবাহ বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রভৃতি।

এই নদকে টিকিয়ে রেখে মিষ্টি পানির আধার গড়ে তোলার কথা অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছে, একাধিকবার দখল উচ্ছেদ করা হয়েছে কিন্তু আবারও সব কিছু দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, নদে প্রবাহ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। প্রবাহ না থাকলে নদ-নদীটিকে থাকে না। শোনা যাচ্ছে, এই নদটি খনন করা হবে কিন্তু কবে, কোথায়, কি ভাবে বা কোন কর্তৃপক্ষ এই খনন কাজ বাস্তবায়ন ও তদারকি করবে, তা অস্পষ্ট।

খুলনা ওয়াসার ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে ১৫ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এর মধ্যে ওয়াসা মাত্র সাত লাখ মানুষকে তার সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। এর অর্থ তাদের দাবি অনুযায়ী আট লাখ নাগরিক এখনও তাদের সেবার আওতায় আসেনি। উপরন্তু নগরীতে অবকাঠামো বাড়ছে, বসতি বাড়ছে, সমান তালে পানির চাহিদাও বাড়ছে সেই হিসেবে ওয়াসার সামর্থ্য বাড়ছে না। সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে এমন কোন সুযোগও দেখছি না। বরং অব্যাহতভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি টেনে তোলায় নগরীর ভূ-গর্ভের নোনা পানি মিষ্টি পানির স্তরের সাথে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদি তেমনটি ঘটে, তাহলে এই নগর ও নগরবাসীর জন্যে বড় দুর্যোগ-দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। এছাড়া মধুমতির পানিতে নোনার স্থিতিকাল ধীরে ধীরে বাড়ছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জাতীয় পানি নীতিতে বলা আছে যে, যে কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে জনগণের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অথচ আমরা পানি সমস্যা সমাধানে বা ময়ূর নদ ব্যবস্থাপনায় কি প্রকল্প গৃহীত হতে যাচ্ছে, তা নগরবাসী বিন্দু-বিসর্গও জানে না। এডিবি ও জাইকার নীতিমালায়ও জন-অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর কোন কিছুরই বাস্তব প্রতিফলন নেই। এর প্রেক্ষিতে জনপ্রতিনিধি, সরকারের কাছে ১১ দফা দাবি তুলে ধরা হলো।

দাবিগুলো হচ্ছে:

১/ মধুমতি নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমে নোনা আক্রান্ত হয়, তা পান যোগ্য নয়, এমন অবস্থায় কেন ওই প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলো? এই অদূরদর্শী প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের উপর বিদেশী ঋণের বোঝা বাড়ানোর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

২/ময়ূর নদ সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

৩/নদটি খননের বিষয়ে কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে বলে শোণা যাচ্ছে। কি ধরণের কার্যক্রম, কারা এবং কি ভাবে বাস্তবায়িত হবে; এ সম্পর্কিত সকল তথ্য নগরবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে হবে।

৪/ময়ুর নদকে ঘিরে মিষ্টি পানির আধার গড়ে তুলতে হবে।

৫/ময়ূর নদের পানির বায়োলজিক্যাল স্ট্যাটাস নিরীক্ষণ করে পর্যায় ক্রমিক ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে পানিকে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে হবে।

৬/নদের পাড়ের সকল অবৈধ স্থাপনা আইনগত ভাবে উচ্ছেদ করতে হবে।

৭/বর্তমানে খুলনা নগরীর ৬০ শতাংশ পানি বিভিন্ন ভাবে ভূ-গর্ভস্থ থেকে তোলা হচ্ছে। এই পানি বিভিন্ন ভাবে অপচয় করা হচ্ছে। অপচয় এখনই কমিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি শুধুমাত্র পানের জন্য নির্দিষ্ট করা উচিৎ। পানির চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন এলাকায় অনুমোদিত ভাবে/ ব্যবসায়িক কাজে/ ভবন নির্মানের কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

৮/বহুতল ভবনে ব্যবহৃত উৎপাদক নলকূপের উপর বেশী হারে কর নির্ধারণ করতে হবে।

৯/পানির যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের জন্য ওয়াটার রেগুলেটরি কমিশন গঠন করতে হবে।

১০/সাব মারসিবল পাম্প স্থাপনে বিধি-নিষেধ আরোপ করতে হবে।

১১/খুলনা ওয়াসা দুটি পানির লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা করতে পারে। একটি খাবার পানির, অন্যটি গৃহস্থলি কাজে ব্যবহারের জন্য। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি একটু ব্যয় বহুল হলেও এতে ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। অন্যথায় একক লাইনে খুলনা ওয়াসাকে খাওয়ার উপযোগী শত ভাগ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতির দায় প্রকৃতির ওপর চাপিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এর মূলে রয়েছে নীতি নির্ধারকদের অদূরদর্শিতা। ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে কখনো পানি সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। এতে একদিকে পরিবেশ বিপর্যয় হবে, অন্যদিকে সংকট আরো বাড়বে। এ সংকট নিরসনে প্রাকৃতিক উৎসের উপর নির্ভরশীলতার কোন বিকল্প নেই। এ জন্য খুলনাবাসীর দাবি, নগরের পার্শ্ববর্তী ময়ূর নদকে ব্যবহার করতে হবে। এর পানি সারফেসওয়াটার ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে শোধন করলে নগরবাসীর পানি সমস্যা লাঘব হবে।

সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের আহবায়ক এড. কুদরত ই খুদা, মাহফুজুর রহমান মুকুল, অজান্তা দাস, মাসুদুর রহমান রঞ্জু, মেরিনা যুথি, এড. জাহাঙ্গীর হোসেন, আফজাল হোসেন রাজু, এড. মামুনুর রশীদ, খলিলুর রহমান সুমন,শরিফুল ইসলাম সেলিম প্রমূখ।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!