আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর ৮ মাসে বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের মহোৎসব চলে। আর এ লুটপাটের অন্যতম হাতিয়ার ছিল দায়মুক্তি আইন। এ দায়মুক্তি আইন অনুযায়ী বিনা টেন্ডারে সরকার সমর্থক ব্যবসায়ীদের উচ্চ মূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রেই কম মূল্যের সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ রেখে বেশি মূল্যের কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক জ্বালানির নিশ্চয়তা না করে দলীয় লোকদের পকেট ভারী করার জন্য বছরের পর বছর নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব উচ্চ মূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের দলীয় সমর্থক ব্যক্তিদের পকেটে চলে গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জের নামেই হাতিয়ে নেয়া হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। আর বেশি দামের বিদ্যুৎ কিনে সরবরাহ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) পথে বসানো হয়েছে। তাতে ১৪ বছরে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ২ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। আর এ দায়মুক্তি কালো আইনের কারণে দলীয় লোকদের পার করে দিতে গিয়ে গ্রাহকের ঘাড়ে চেপেছে বাড়তি বিদ্যুতের মূল্য।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকার বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইনের আওতায় এক সময়ে উচ্চ মূল্যের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। ২০১০ সালে বলা হয়েছিল এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র আপদকালীন চাহিদা মেটানোর জন্য। তিন বছর পর বিদ্যুৎ নিয়ে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল থেকে আর বিদ্যুৎ নেয়া হবে না। সময়ের প্রয়োজনে এ সিদ্ধান্ত অনেকটা দায় ঠেকে হলেও সাধুবাদ জানালেও এটি এখন দেশ ও দেশের জনগণসহ সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য গলার কাঁটা হয়ে গেছে। তিন বছরের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গত দেড় দশকেও বন্ধ করা যায়নি। এতে এ খাতে ব্যয় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আর এ ব্যয়ের দায় জনগণের ঘাড়ে চেপে বসেছে। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কুইক রেন্টাল ও সব রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, তাদের চুক্তি অনুযায়ী এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিতে না পারলে তার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে। এখানে কোনো কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী উৎপাদন সক্ষমতা না থাকলেও অথবা বিদ্যুৎকেন্দ্র নষ্ট থাকলেও তা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা প্রতি বছর যাচাই করার কথা। আর সে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়। প্রতি বছর এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা যাচাই করা হয় না। অর্থাৎ এখানে বড় ধরনের জালজালিয়াতির আশ্রয় নেয়ার সুযোগ রয়েছে। কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলছে। আবার বলা হচ্ছে, উৎপাাদন ক্ষমতা প্রকৃত চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট। পুরো গরমে গড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়নি। তাহলে এ ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কেন এখনো চালু রাখা হচ্ছে। আর কেনইবা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে জনগণের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে কিছু বিদ্য্যুৎ ব্যবসায়ীর পকেটে দেয়া হচ্ছে। এটা নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে বলে তারা মনে করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালগুলোর বেশির ভাগেরই উৎপাদন সক্ষমতা আগের মতো নেই। কিন্তু বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে উৎপাদন সক্ষমতা আগের মতোই রেখে দিন দিন ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়িয়ে নিচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতা কমলেও বেসরকারি বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের ব্যয় কমছে না বরং দিন দিন বেড়ে চলছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনোটির তিন-চার বার চুুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর ১৫ বছরের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৭৮৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে ১৬ অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৩৩৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ৬৩ হাজার ৪৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে যত সমালোচনা : বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়, সেটারই আনুষ্ঠানিক নাম ক্যাপাসিটি চার্জ। বিদ্যুৎ খাতের বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে শুরু থেকে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সমালোচনামুখর ছিলেন। এ পদ্ধতিকে ‘রাষ্ট্রের অর্থ লুটপাট’র সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করে তীব্র সমালোচনা করেন তারা।
এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় যখন সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তৈরি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জকে একটি ‘লুটেরা মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবিকে লোকসান গুণতে হয় প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। এর আগের ১২ বছরে সংস্থাটি লোকসান গুনেছে এক লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার মোট যা লোকসান করেছে, তার চেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে গত দুই অর্থবছরে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতার মাত্র ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এর কারণ জ্বালানি ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের সরবরাহ করতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়।
কার কত ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে
গত বছরে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সরকারের তিন মেয়াদে দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ/রেন্টাল পেমেন্ট) বাবদ ১ লাখ ৪ হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ৮২টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (আইপিপি) মধ্যে ৭০টিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত (৩০ জুন ২০২৩) পরিশোধ করা হয়েছে ৭৬ হাজার ২৪২ কোটি ৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে গত সাড়ে ১৪ বছরে দেয়া হয়েছে ৭ হাজার ৪৫৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ চার্জ পাওয়া অন্যান্য আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে মেঘনা পাওয়ার লিমিটেডকে ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি ১২ লাখ, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে ৪ হাজার ৪ কোটি ৮ লাখ, সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডকে ৩ হাজার ৬৪৪ কোটি ৩৯ লাখ, সেমক্রপ এনডব্লিউপিসি লিমিটেডকে ২ হাজার ৮২৩ কোটি ৬৬ লাখ, এপিআর এনার্জিকে ২ হাজার ৭৮৮ কোটি ৪ লাখ, সামিট বিবিয়ানা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে ২ হাজার ৬৮৩ কোটি ৩ লাখ, হরিপুর পাওয়ার লিমিটেডকে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি ৬৩ লাখ, ইউনাইটেড আশুগঞ্জ এনার্জি লিমিটেডকে ২ হাজার ৩৭৬ কোটি ৬৪ লাখ ও বাংলা ট্র্যাক পাওয়ার ইউনিট-১ লিমিটেডকে ২ হাজর ৮৫৩ কোটি ২২ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এ দিকে আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে ৩২টি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে (রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট) ভাড়া বাবদ দেয়া হয়েছে ২৮ হাজার ৬৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে অ্যাগ্রেকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস তার পাঁচটি ইউনিটের মাধ্যমে ৬ হাজার ৪১১ কোটি ২২ লাখ টাকা পেয়েছে। এ ছাড়া অ্যাগ্রেকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস (১৪৫ মেগাওয়াট) ২ হাজার ৩৪১ কোটি ২৮ লাখ, কেপিসিএল (ইউনিট-২) ১ হাজার ৯২৮ কোটি ৫৪ লাখ, সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৬১ লাখ, অ্যাগ্রেকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস ১ হাজার ৫৫৮ কোটি ২৩ লাখ, ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ১ হাজার ৫৩০ কোটি ৯ লাখ, অ্যাক্রন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসেস লিমিটেড ১ হাজার ৪৮৪ কোটি ৩০ লাখ, অ্যাগ্রেকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস ১ হাজার ৪৩৯ কোটি ১৯ লাখ, দেশ এনার্জি সিদ্ধিরগঞ্জ ১ হাজার ৩৯১ কোটি ২১ লাখ, ম্যাক্স পাওয়ার ১ হাজার ৩০৬ কোটি ৩৪ লাখ ও পাওয়ার প্যাক মুতিয়ারা কেরানীগঞ্জ ভাড়া বাবদ পেয়েছে ১ হাজার ২৯১ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
এ দিকে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি)। এ ঘাটতি মেটাতে সংস্থাটিকে প্রতি বছর ভর্তুকি হিসেবে বড় অঙ্কের অর্থ দিচ্ছে সরকার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছিল ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। অন্য দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ (কাপাসিটি চার্জ) ব্যয় করা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ থেকে দেখা যায়, বিদ্যুৎ খাতের জন্য দেয়া ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক সংস্কার হওয়া দরকার। যারা বিনা প্রয়োজনে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে জনগণের কষ্টের টাকা নিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় দেশের বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির বোঝা অর্থনীতিকে বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
খুলন গেজেট/এনএম