যশোরের অভয়নগর উপজেলায় ফরিদা বেগম ওরফে ফরি পাগলী (৬৮) নামের একজন মস্তিস্কবিকৃত বৃদ্ধার প্রায় সাড়ে ১২ শতক জমি লিখে নিয়েছে তারই আপন ভাইপো আমিনুর রহমান। ভাইয়ের বাড়ির আশ্রিতা হওয়ায় সুযোগ বুঝে উপজেলার ২০ নং দেয়াপাড়া মৌজার ৭৪ নং খতিয়ানের আর এস ৩৯২১ দাগের ১৫ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের ১২.২৫ শতক জমি হেবাবিল এ্যাওয়াজ দলিল (দানপত্র) করে লিখে নিয়েছে সিংগাপুর প্রবাসী ওই ভাইপো।
পাগলী বলে দীর্ঘ ৩০ বছরেরও অধিক সময় খোঁজ খবর না নেয়া স্বামীর স্বাক্ষরে এ জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে এবং পিতার কাছে থাকা ফরিদা বেগমের দুই ছেলে ও স্বামী এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে এ জমি লিখে দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ২৪৯৩ নং দলিলে এ জমি রেজিস্ট্রি হয়। এদিকে মস্তিস্ক বিকৃত ও এলাকাবাসীর কাছে ফরি পাগলী নামে পরিচিত ফরিদা বেগমের কোন জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা সত্বেও কিভাবে তার জমি রেজিস্ট্রি হলো এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা সমালোচনা। সেই সাথে দলিল লেখক ও দলিলের শনাক্তকারী অভয়নগর উপজেলা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ( লইসেন্স নম্বর- ৫৯) ও তৎকালীন সাব রেজিস্টার মোঃ ওমর ফারুককে নিয়ে শুরু হয়েছে সমালোচনা।
অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ কায়দায় ম্যানেজ হয়ে তারা এ জমি রেজিস্ট্রিতে সহযোগিতা করেছেন। অবশ্য জমি লিখে নেয়ার পর থেকে ফরিদা বেগমের ভাইয়ের বাড়িতে মানবেতর জীবন যাপন করছে। একটি পরিত্যাক্ত ঘরে রাত কাটান ফরিদা। খেতে দেয়া হয় উঠানের কোনে।
সরেজমিনে ফরিদা বেগমের আশ্রয়দাতা ভাই আব্দুল গাজীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ফরিদা বেগমকে উঠানের এক কোনে কেবল মাত্র কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খেতে দেয়া হয়েছে।
জমি সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতেই ভাত খাওয়া বন্ধ করে ক্ষিপ্ত কন্ঠে ফরিদা বলেন, “ আমার জমি আমারে বুঝে দিতি হবে। আমি কোন জমি লিখে দি নি।”
ঘটনাটি ঘটেছে, অভয়নগর উপজেলার শ্রীধরপুর ইউনিয়নের দেয়াপাড়া গ্রামে। জানাগেছে, ওই গ্রামের মৃত আজগর গাজীর মেয়ে ফরিদা বেগম। দুই ভাইয়ের এক বোন ফরিদার ৪০ বছর আগে যশোরের রাজারহাট এলাকার আকবর মন্ডলের সাথে বিয়ে হয়। সেখানে ফরিদার কোল জুড়ে জন্ম নেয় দুইটি ছেলে সন্তান। সুখেই সংসার করছিলেন ফরিদা। ত্রিশ বছর আগে মস্তিস্কবিকৃতি ঘটলে তার স্বামী তাকে বাবার বাড়ি ফেলে রেখে যায়। সেই থেকে ভাই আবুল গাজীর আশ্রিতা হয়ে আছেন ফরিদা। যদিও ফরিদা পারভীনের সাথে কথা বলে তাকে মস্তিস্ক বিকৃত উম্মাদ মনে হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুইজন প্রতিবেশি জানিয়েছেন, ফরিদা পুরোপুরি পাগল না। তাকে চিকিৎসা করালে সুস্থ্য হয়ে যেতো। কিন্তু চিকিৎসা করানোর কেউ নাই। স্থানীয়দের অভিযোগ, যে স্বামী ত্রিশ বছর স্ত্রীর খোঁজ নেয়নি সেই স্বামীকে এনে কিভাবে ফরিদা বেগমের জমির দানপত্র দলিল করে নিলো ভাইয়ের পরিবার। অবশ্য আব্দুল গাজীর স্ত্রী শাহানা বেগমের দাবি, ফরিদা বেগমের স্বামী তিন/চার বছর পরপর একবার এসে খোঁজ নিয়ে যেতেন। যদিও ফরিদা পারভীনের স্বামী বা সন্তানদের সাথে যোগাযোগের যথার্থ ঠিকানা বা তাদের কোন ফোন নম্বর দিতে পারেননি তিনি।
সরেজমিনে ওই বাড়িতে গিয়ে আব্দুল গাজীর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি ঘর থেকে বের না হওয়ায় তার স্ত্রী শাহানা বেগমের সাথে কথা বলেন প্রতিবেদক। শাহান বেগম বলেন, আমার ছেলে আমিনুর রহমান সিংগাপুর থেকে এসে ফরিদা বেগমের স্বামীর হাতে এক লাখ টাকা দিয়ে এ জমি লিখে নিয়েছে। ফরিদা বেগম স্বেচ্ছায় সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে এ জমি লিখে দিয়েছে। ত্রিশ বছর যাবৎ আমরা ফরিদার দেখভাল করছি। যতদিন বেঁচে থাকবে আমরাই দেখভাল করবো। এ কারণে তার জমি আমরা লিখে নিয়েছি। জমি লেখার পর আমিনুর রহমান পুণরায় সিংগাপুর চলে যাওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য আব্দুল্লাহ এর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে পাগলীর জমি কিভাবে রেজিস্ট্রি হলো তা আমার বোধগম্য নয়। বিষয়টি আমাকে হতবাক করেছে।
এ প্রসংগে শ্রীধরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাড. নাসিরুদ্দিন বলেন, তিনি সম্প্রতি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। পাগলীর জমি রেজিস্ট্রি হওয়ার বিষয়টি তার জানা নেই।
এ ব্যাপারে অভয়নগর উপজেলা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি ও ফরিদা পারভীনের জমির দলিল লেখক এবং দলিলের শনাক্তকারী আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, “পাগলী কিনা জানিনা। সাব রেজিস্ট্রারের সামনে এসে জমির মালিক না বললে তো আর দলিল রেজিস্ট্রি হয়নি। জাতীয় পরিচয়পত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র আছে কিনা তা মনে নেই। মূল দলিল দেখলে বোঝা যাবে।”
অভয়নগর উপজেলা সাব রেজিস্টারের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া যায়নি।