খুলনার রূপসায় একটি বেসরকারী ক্লিনিকে চেকআপ করানোর সময় ক্ষতির ভয় দেখিয়ে প্রসূতি মায়ের সিজার করার অভিযোগ উঠেছে। পরিপক্ক না হওয়ায় নবজাতক শিশুটি মারা গেছে। এ ঘটনায় রূপসা থানায় অপচিকিৎসায় নবজাতক মৃত্যুর অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিযোগ ও রোগীর স্বজন সূত্রে জানা যায়, রূপসা উপজেলার টিএসবি বাহিরদিয়া ইউনিয়নের পাঁচানী গ্রামের আব্দুল্লাহ আল হাসানের স্ত্রী বৃষ্টি (২৪) কিছুটা অসুস্থবোধ করলে চেকআপের জন্য গত ১১ মার্চ বিকেলে উপজেলা পরিষদের সামনে অবস্থিত আজকের সারাদেশ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিকে আসেন। তখন ওই ক্লিনিকে কোন চিকিৎসক ছিলেন না। একজন নার্স চেকআপ করে বলেন বাচ্চার হার্টবিট কমে গেছে, নড়াচড়া নেই। আর প্রসূতির পেটের পানি শুকিয়ে গেছে। এক্ষুণি সিজার করে বাচ্চা বের না করলে বাচ্চা ও প্রসূতি মা উভয়ের সমস্যা হবে বলে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাগিদ দেন। তখন রোগির স্বজনরা বাচ্চার অপরিপক্কতার কথা জানিয়ে বলেন, পূর্বের রিপোর্ট অনুযায়ি সন্তান প্রসাবের সম্ভব্য তারিখ ২০ এপ্রিল। এখনও প্রায় দেড় মাস বাকী রয়েছে। এরই মধ্যে প্রসূতি মাকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রসূতি মা স্বাভাবিক হয়ে ও সন্তানের নড়াচড়া স্বাভাবিক হয়। তখন ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ দ্রুত সিজার করার জন্য তোড়্জাড় করেন। কোন চুক্তি ছাড়াই ৬ হাজার টাকা জমা নিয়ে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অন কলের মাধ্যমে ডা. মনোয়ার হোসেন নামক একজন চিকিৎসককে দিয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় প্রসূতির সিজার সম্পন্ন করেন। তাৎক্ষণিক নবজাতক অসুস্থ হয়ে পড়লে খুলনা শিশু হাসপাতালে রেফার করা হয়। রোগির স্বজনরা নবজাতককে নিয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় পরের দিন ১২ মার্চ রাতে নবজাতকের মৃত্যু হয়।
প্রসূতির স্বামী আব্দুল্লাহ আল হাসান বলেন, আমার স্ত্রী অসুস্থবোধ করলে চেকআপের জন্য ওই ক্লিনিকে নেয়া হয়। তারা তড়িঘড়ি করে ভয় ধরিয়ে দিলে আমরা সিজারের সম্মাতি দেই। তারা অপারেশনের আগে কোন পরিক্ষা-নিরিক্ষা করিনি। একজন ডাক্তার এসে অপারেশন করে ফেলে রেখে চলে যায়। তিন দিনের মধ্যে আমার স্ত্রীর কাছে আর কোন ডাক্তার আসেনি। নার্স ও ম্যানেজার আমার স্ত্রীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। অপারেশনের সময় কোন অজ্ঞানকরার ডাক্তার ছিলেন না।
তিনি আরও বলেন, একটি ক্লিনিক করেছেন তবে কোন ডাক্তার থাকেনা এটা আমরা জানতাম না। আগে জানলে এখানে কখনও আসতাম না। এনারা ক্লিনিকের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। তাদের কারণে আমার ছেলে মারা গেছে। আমি এর বিচার চাই। তার মত যেন আর কারো ক্ষতি না হয় সেজন্য ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
সরেজমিন ১৩ মার্চ বিকেলে আজকের সারাদেশ ক্লিনিকে যেয়ে দেখা যায়, রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সন্নিকটে উপজেলা পরিষদের সামনে গড়ে তোলা হয়েছে আজকের সারাদেশ হাসপাতাল এন্ড ডায়গনস্টিক নামের ওই বেসরকারী ক্লিনিকটি। সেখানে কোন মেডিকেল অফিসারকে পাওয়া যায়নি। সেখানে দেখা হয় ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ নাজমুল ইসলাম পারভেজ এর সাথে।
তাঁর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অবহেলায় শিশু মৃত্যু হয়নি। আর আমাদের এখানেও কোন শিশু মারা যায়নি। রোগির পারিবারিক দ্বন্দ্বের জন্য স্বামীর পক্ষ থেকে অপচিকিৎসার অভিযোগ আনা হচ্ছে। যেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। পরীক্ষা নিরীক্ষা না করা বিষয়ে তিনি বলেন, প্রসূতির অন্য ডায়াগনষ্টিক থেকে রক্ত, প্রসাব, আল্ট্রাসোনো পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় পরিক্ষা করা ছিল। এজন্য আমরা সেগুলো দেখে রোগির জরুরী অবস্থা ও অতিরিক্ত খরচের কথা বিবেচনা করে আর পরিক্ষা করায় নি। রোগির ব্যথা উঠার পরে স্বজনদের অনুরোধে দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করি। আর অপারেশনের সময় মেহেদী নামের একজন অচেতনবিদ ছিলেন।
প্রসূতি বৃষ্টি বলেন, পেটে বাচ্চার নড়াচড়া টের পাচ্ছিলাম না, এজন্য হাসপাতালে যাই। সেখানে অক্সিজেন দেওয়ার পরে বাচ্চার নড়াচড়া অনুভূত হয়। তেমন কোন ব্যথা ওঠেনি তবে সামান্য সামান্য ব্যথা করতে ছিল। অপারেশন থিয়েটরে নেওয়ার পরে ডা. মনোয়ার হোসেন আমাকে একটা ইঞ্জেকশন দেন, তারপরে আর তেমন কিছু জানিনা।
রোগীর চেকআপ করা নার্স বলেন, এখানে যখন আনা হয় তখন বাচ্চার সামান্য মুভমেন্ট ছিল। অক্সিজেন সাপোর্টে রাখার পরে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। বাচ্চা বের করার সময় কোন কান্না করেননি।
এ বিষয়ে ডা. মনোয়ার হোসেন বলেন, আমি অন কলে অপারেশন সেখানে যাই। কিভাবে কি হয়েছে সেটি বিস্তারিত জেনে আপনাকে জানাচ্ছি। আর শিশু রেফার্ডের পরে মারা গেলেতো আমাদের দায়ভার থাকে না। পরবর্তীতে যিনি চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি বলতে পারবেন। অপরিপক্ক অবস্থায় অপারেশন করার বিষয়ে তিনি বলেন, হয়ত রোগির ঝুঁকি ছিল। ব্যথা উঠেছিল। এজন্য হয়ত কাউন্সিলিংয়ের পরে রোগির স্বজনদের অনুমতি নিয়ে অপারেশনের ব্যবস্থা করেন। এটা জেনে জানাবো। তবে পরে তিনি আর কল রিসিভ করেন নি।
রূপসা থানা অফিসার ইনচার্জ সরদার মোশাররফ হোসেন শিশু মারা যাওয়ার বিষয়ে থানায় লিখিত অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, বিষয়টি মীমাংশা হয়ে গেছে। তবে অভিযোগকারী হাসান বলেন, কোন মিমাংশা হয়নি।
রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে আমার কাছে কোন অভিযোগ আসেনি। আর আমাদেরও তেমন কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি। রিপোর্ট করে দেন, সিভিল সার্জন অফিস থেকে তদন্তে আসুক। মেডিকেল অফিসার না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, তারা কিভাবে চালাচ্ছে আমরাতো আর ভিতরে যেয়ে দেখি না। কোন অনিয়ম করে থাকলে নিয়মানুযায়ি তার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহম্মেদ বলেন, বিষয়টি আমি জেনেছি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সন্তান প্রসবের নির্দিষ্ট তারিখ থেকে দেড় মাস আগে সিজার করা উচিত নয়। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর অপারেশন করতে হলে ক্লিনিকে অবশ্যই ২৪ ঘন্টাই নূন্যমত একজন মেডিকেল অফিসার থাকতে হবে।
খুলনা গেজেট/কেডি