খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯৯০
  কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বাসা থেকে ২ সন্তানসহ বাবা-মায়ের মরদেহ উদ্ধার
  কুমিল্লায় অটোরিকশায় ট্রেনের ধাক্কায় নিহত বেড়ে ৭

‘দুঃখ লাগে যে আমরা বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার করতে পারিনি’

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিউরসহ আরও অনেকেই। সেই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল খুলনার ছাত্রসমাজও। ‘পুলিশের জুলুম চলবে না’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এমন স্লোগানে প্রকম্পিত ছিল খুলনার রাজপথ। এই আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নারীরাও।

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কথা হয় ভাষা সৈনিক মাজেদা আলীর সঙ্গে। তিনি তুলে ধরেন ৭১ বছর আগের স্মৃতি। বলেন, বর্তমানে বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এমনকি গবেষণা ও সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়নি। ‘সো আর বাট’ বলতেই সবাই অজ্ঞান।

ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ভাষাসৈনিক মাজেদা আলী বলেন, আমরা তো কিছু জানতাম না, তখন তো রেডিও-টেলিভিশন ছিল না। টেলিফোনও সবার বাড়িতে ছিল না। বৃহস্পতিবার ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালে রেলওয়ে স্কুলে চাকরি করতাম। স্কুলটা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। স্কুল থেকে ফিরে আসছি। তখন দেখি কলেজ গেটের সামনে কয়েকটা লোক দাঁড়ানো। তাদেরকে তখনো ভালো করে চিনি না। তখন কিন্তু বাহিরে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার নিয়ম ছিল না। সেখানে বিএল কলেজের ছাত্র এম নুরুল ইসলাম, মালেক আতাহার আর গাজী শহীদুল্লাহ ছিলেন। তারা বললেন- জানেন আজকে ঢাকায় কী হয়েছে? কয়েকজন মারা গেছে ভাষার জন্য। বললেন- আপনাদের তো কিছু করতে হবে। আমি বললাম কী করবো আমরা? তারা বললেন- মিছিল বের করেন, প্রতিবাদ জানান। তখন আমরাতো মিছিল কীভাবে করে বুঝি না। মেয়েরা তো এত অ্যাডভান্স হয়নি। তখন মালেকা আতাহার নুরুল ইসলাম দাদু ভাইয়ের বোন কলেজে পড়তো।

আমরা মিছিল করব কাদের নিয়ে এমন প্রশ্নে তারা বললেন- মেয়েদের স্কুল মেয়েদের নিয়ে করবেন। তখন সুলতানা হামিদ আলী আর করোনেশন স্কুলটি মেয়েদের জন্য ছিল। তারা বললেন- আপনাদের বলে দেব কী করতে হবে, আগে সব গুছান। পরের দিন শুক্রবার আমরা গোছাতে থাকলাম। আমার একটা বান্ধবী ছিল রোকিয়া, তাকে সাথে নিলাম। আমাদের স্কুলের আয়ার কাছে গেটের চাবি থাকতো। সে থাকত মূল গেটের সামনে। পর দিন ভোর বেলা আমরা বুদ্ধি করলাম গেট কী করে খোলা যাবে। ছুটির দিন যাদের যাদের বাড়ি চিনি তাদের বাড়ি গিয়ে বললাম স্কুল ড্রেস পড়ো না, বই নিও না, আমাদের সাথে মিছিল করতে হবে। সহপাঠীদের নিয়ে সকাল ৮টার ভেতরে চলে যাবা। মেয়েরা সকলে মিলে দেবলা মাসির বাসায় গিয়ে বললাম ‘মাসি তুমি কাল স্কুলে যাবা না। তোমার খুব জ্বর হয়েছে বাসায় শুয়ে থাকবে। আর দারোয়ান বচন মিয়া চাবি চাইলে বলবা চাবি খুঁজে পাচ্ছি না।

শুক্রবার সন্ধ্যায় আমাদের কাছে কিছু জিনিস দিয়ে গেলেন উনারা। কিছু গড়নের লাঠি, চাটাই, কাগজ আর কী লিখতে হবে তাই দিলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-সহ বিভিন্ন স্লোগান লিখতে হবে। রাতভর হোস্টেলে কাঠির মাথায় তুলা জড়িয়ে আলতা ও দোয়াত কালিতে ডুবিয়ে লেখা হলো। ময়দা কিনে এনে জাল দিয়ে সেগুলো চাটাইয়ে লাগানো হলো। লাঠির সঙ্গে সেগুলো বানলাম কিন্তু এতোগুলো জিনিস নিয়ে সকাল বেলা বের হবো কীভাবে। হোস্টেলের মেয়েদেরকে সব বোঝানো হলো। পেছনের দিকে ছোট্ট একটা দরজা ছিল। মেয়েদের ওই দরজা দিয়ে বের হতে বললাম। দেবলা মাসির কাছ থেকে চাবি ছিনিয়ে নিলাম।

আমরা সামনের দরজা দিয়ে বের হলাম। প্লাকার্ড হাতে নিয়ে আমরা যাচ্ছি। তখনকার সময়ে মিছিল করতো দুজন দুজন করে, রাস্তা জোড়া না। দুজন দুজন করে আমরা লাইন দিলাম। আমাদের সহযোগিতা করলো দন্ত চিকিৎসক অতুলেন্দ্রুনাথ দাসের বাড়ির স্কুল পড়ুয়া তিন মেয়ে খুকু, রত্না ও ঝঞ্ঝা। এরা বাড়ি থেকে চোঙা নিয়ে আসলো। মিছিলে যা বলা হবে সেটা তারা বলতে থাকলো আর অন্য মেয়েরা সেইভাবে চলতে লাগলো। আমরা সেখান থেকে পিকচার প্যালেস মোড় ঘুরে থানার মোড় হয়ে পার্ক ও পৌরসভার মোড় থেকে পোস্ট অফিসের রাস্তা ঘুরে আহসান আহমেদ রোডের মাথায় এসে মিটিং করলাম। রাস্তায় পুলিশ ছিল, কিন্তু তারা আমাদের কিছু বলেনি। ২৩ ফেব্রুয়ারি এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনে নারীদের প্রথম মিছিল।

এরপর জোহরের আজানের সময় চলে এলাম। আমরা ভাবলাম অনেক কিছু করেছি। পর দিন ভোর বেলায় কলেজের প্রিন্সিপাল অমূল্য ধন সিংহ স্কুলে চলে আসেন। আমাকে ডেকে পাঠান। আমারতো ভয়ে বুক কাঁপছিল। স্যার এতো সকালে আসলেন! তারপর সামনে গেছি, কিন্তু স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি না। ভয় পাচ্ছি আর কি, এতো সকালে এসে স্যার আমাকে ডাকলেন কেন? স্যার আমাকে বললেন- ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি যেটা করেছো, খুব ভালো কাজ করেছো। কিন্তু তুমি পুলিশের নজরে পড়ে গেছো। তুমি এখানে থাকবে না, কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে। গা ঢাকা তো বুঝি না। বললেন- তুমি কয়েকদিন এখানে থাকবে না, তোমার বাবার বাড়িতেও থাকবে না। অন্য কোথাও গোপনে থাকবে। কাউকে বলবে না তুমি কোথায় আছো।

স্যার বার বার বললেন ভয়ের কিছু নেই। আমি খুব চিন্তাই পড়ে গেলাম। আমি স্কুলে কাজ করতাম সেই স্কুলে একটি ছুটির দরখাস্ত দিলাম রিকশাওয়ালার কাছে। আমি তখন চলে গেলাম মুসলিম লীগের এক নেতার যশোরের বাড়িতে। তার স্ত্রী খাদিজা বেগম আমার পরিচিত। আর ওই বাড়ির নিচতলায় যশোরের আরেকজন ছিলেন কবি হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন। তিনি ছিলেন ডাক্তার মাহবুবুর রহমানের আব্বা, পরবর্তীকালে জেনেছি। করোনেশন স্কুলে চাকরি করতেন। উনি আমাকে দুদিন ডেকে নিয়েছিলেন। বই লিখতেন, চোখ নষ্ট, কষ্ট হয়। তাই বলতেন- তুমি একটু প্রুভ দেখে দিবা আমাকে বিকেলে বিকেলে। দুই-তিন দিন গেছি, প্রুভ দেখে দিয়ে আসছি। ওই থেকে চিনেছেন তারা আমাকে। ওই বাড়ির গৃহিণীকে বললাম- খালাম্মা আমার হোস্টেলে থাকার খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমি কি একটু আপনার এখানে থাকতে পারবো? বললেন- তুমি থাকবা কোথায়? আমারতো সে রকম ঘর নেই। আমি বললাম কোনো এক জায়গায় থাকলেই হবে। বললেন- কয়দিন থাকবা? আমি বললাম দুই-তিন দিন থাকবো। তিনি বললেন- আমার তিন মেয়ে এক ঘরে থাকে সেখানে যদি তুমি জায়গা করে নিতে পারো তাহলে থাকো। আমি সেখানে গিয়ে থাকতে লাগলাম। শরীর খারাপ বলে থাকতে লাগলাম, বের হতাম না।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা সেদিন যে প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করেছিলাম, ভাবতাম যে আস্তে আস্তে সব কিছু হবে। যার ধারাবাহিকতায় ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ হলো, সবই হলো। কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি আমরা বাংলা ভাষাটাকে ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত করতে পারলাম না। বাংলা ভাষা নিয়ে কোনো গবেষণা বা কিছু হলো না। আমরা উর্দু নিব না ভালো কথা, কিন্তু বাংলা ভাষাটাকে সঠিকভাবে চর্চা করবো, কাজে ব্যবহার করবো। এখন কথায় কথায় সব দেখি তিন ভাগের একভাগ ইংরেজিতে কথা বলে ‌‘সো আর বাট’ বলতেই সবাই অজ্ঞান। এমনকি বেতারেও আমি শুনি যে তারা সঠিক বাংলা ব্যবহারটা করেন না, টেলিভিশনেও তাই দেখি।

খুলনার এই নারী ভাষাসৈনিক বলেন, দুঃখ লাগে যে আমরা বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার করতে পারলাম না। ঢাকাতে শুনেছি যে সেগুনবাগিচায় মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে। সেখানে যে কী কাজ কর্ম হয় বা কী হয় না হয় তাও আমি সঠিকভাবে জানি না। এখনো বহু বই আমরা বাংলায় করতে পারিনি। যে শব্দগুলো কঠিন সেগুলোতে আমরা ইংরেজি রেখে দিয়েওতো বাংলা করতে পারতাম। বিজ্ঞানের, মেডিকেলের, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যেগুলো সেগুলো বাংলা করার চেষ্টাতো থাকতে হবে। গবেষণার জন্য কাজে লাগিয়ে দিলে কত কাজে দিত, কিন্তু সেগুলো কেউ নজর ও আমলে আনেন না। এটাই আমার দুঃখ লাগে।

৮৬ বছর বয়সী এই ভাষাসৈনিক বলেন, সততার খুব অভাব হয়ে গেছে। এটা খুব খারাপ লাগে। সততা নেই। আর পড়াশোনাও সঠিকভাবে তারা করে না। ফাঁকি দেয়। বিশেষ করে এক যুগ ধরে দেশের খারাপ অবস্থা চলছে। যার যা খুশি সে তাই করছে। পড়াশোনার মান নেমে গেছে অনেক। শিক্ষকরা ভালো করে না শেখালে কেমন করে হবে। কারণ ভালো করে শিখতে পারেনি তারা। এখানে তাদের গলদ রয়ে গেছে। আমার মনে হয় যারা শিক্ষক হবেন, তাদেরকে ভালো করে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। উচ্চারণ যদি সঠিকভাবে করতে না পারে তাহলে পিটিআই, বিএড পাস করে কি হবে। ব্যর্থ সৈনিক হবে।

ব্যক্তিজীবন

১৯৫৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর (তখন তিনি সাংবাদিকতা করতেন) সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বেগম মাজেদা আলী চলে যান ঢাকায়। বাবা শেখ আব্দুল জব্বার, মাতা দৌলতুন্নেসা। ১১ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে আর কে কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৭ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৬৯ সালে বিনা বেতনে সুন্দরবন কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। সংসারজীবনে তিনি পাঁচ কন্যাসন্তানের মাতা। তাঁর লেখা কয়েকটি বইয়ের নাম—গৌধূলির স্বপ্ন, ছোটদের ছড়ার বই, হাসি খুশির মেলা, হাসি খুশির খেলা, হাসি খুশির দোলা ইত্যাদি। তিনি খুলনা মহিলা সমিতি ও লেখিকা সংঘের প্রতিষ্ঠাতা।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!