ঘুর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানার প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো মেরামত করা হয়নি সাতক্ষীরার অশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ। ভাঙ্গন পয়েন্ট গুলো দিয়ে নদ-নদীর লোনা পানি ঢোকা অব্যহত থাকায় নিয়মিত জোয়ার ভাটা প্রবাহিত হচ্ছে পুরো ইউনিয়ন জুড়ে। ফলে বসত ভিটার উপর পানি ওঠায় অনেকে পরিবার নিয়ে নৌকায় বসবাস শুরু করেছেন। কেউ উঠেছেন ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে। আবার আশ্রয়হীন হয়ে ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে ইউনিয়নের অনেক বানভাসি মানুষ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতাপনগর ইউনিয়নটি এখন সাগর না সমতল ভূমি তা বোঝার কোন উপায় নেই। অনেকে নদীতে ভাটা হলে বাড়িতে যান আবার জোয়ার শুরু হলে ঘর ছেড়ে রাস্তায় এসে থাকেন। এরই মধ্যে উদ্বাস্তু হয়ে এলাকা ছাড়ছেন অনেক পরিবার। গত কয়েক দিন আগে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করলেও কবে বাঁধ নির্মাণের কাজ হবে তার কোন আশ্বাস দিতে পারেন নি। তবে খুব দ্রুত যাতে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয় সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করবেন বলে আশ্বস্থ করেন তিনি।
এমন খবর প্লাবিত এলাকার মানুষের মাঝে পৌছালে শত শত আশ্রয়হীন মানুষ অন্য কোন উপায় না পেয়ে এলাকা ছেড়ে জেলা শহরের দিকে চলে যাচ্ছে। তবে বানভাসী কিছু মানুষ নিজ ভিটা না ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের উপর, মাছধরা নৌকার উপর, আবার অনেকে ঘরের চালের উপর পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের নাকনা গ্রামের খোদেজা খাতুন জানান, আম্পানের পর প্রায় ৯ মাস নিজের ঘরে রাত কাটাতে পারেননি। অসুস্থ্য অবস্থায় বোনের বাড়ি ও মেয়ের বাড়ি থেকে সময় পার করেছেন। বাঁধ মেরামত হওয়ার পর ঘরে ফিরলেও বেশী দিন থাকতে পারেননি। ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে আবারও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এখন নদীতে জোয়ার আসলে ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এসে থাকেন। নদীতে ভাটা নামলে তখন ঘরে যান। গত এক সপ্তাহ ধরে এই অবস্তা চলছে। পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে সব সময় আতংকে থাকতে হচ্ছে তাকে।
সাতক্ষীরা শহরের রাজারবাগান কলেজ এলাকায় প্রতাপনগর ইউনিয়নের বানভাসী এক বৃদ্ধার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা সপ্তাহ খানেক ধরে চিড়া মুড়ি খেয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। সহায় সম্বল ফেলে বাঁচার তাগিদে এই এলাকায় এসে মানুষের সহযোগিতা বাঁচার চেষ্টা করছি। আমার অনেক কিছু ছিল কিন্তু বার বার নদী ভাঙ্গনের ফলে আমি এখন নিঃস্ব। সর্বশান্ত হয়ে গেছে আমার মতো অনেকেই। রাতারাতি ঘরবাড়ি ছেড়ে পথের ভিখারি হয়ে গেছে শতশত পরিবার।’
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্ষত না শুকাতেই আবারো ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধের কয়েকটি পয়েন্ট উপচে ও বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। জলোচ্ছ্বাসে তার ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া, হরিষখালী, বন্যতলা, দিঘলারাইট, কল্যানপুর, গোকুলনগরসহ বেশ কয়েক স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। এর মধ্যে দিঘলারাইট, কল্যানপুর ও গোকুলনগর এলাকার বেড়িবাঁধ স্থানীয়ভাবে মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু কুড়িকাউনিয়া, হরিষখালী ও বন্যতলার বাঁধ এখনো মেরামত করা সম্ভব হয়নি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত এক সপ্তাহ পার হলেও বাঁধ বাঁধার তেমন কোন উদ্যোগ নেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফলে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর পানি এখনো জোয়ার ভাটা খেলছে আমার ইউনিয়নে। বর্তমানে ইউনিয়নটিতে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ প্লাবিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেক পরিবার বসবাস করছে নৌকায় ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে। তকে এলাকা ছেড়ে কেউ যাচ্ছে কি না এমন তথ্য তার জানা নেই বলে তিনি জানান।
এদিকে এলাকাবাসী বলছে স্থানীয় চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন সরকারিভাবে কিছু ত্রাণ বানভাসী মানুষের মাঝে পৌছে দিলেও সব মানুষের ভাগ্যে তা জোটেনি। অথচ বানভাসী মানুষদের একত্র করে ত্রাণ দেওয়ার নাম করে কিছু শুকনা খাবার দিয়ে ছবি তুলে বেসরকারি সংস্থা ও কিছু স্থানীয় নেতা হাইলাইট হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাস্তবে অসহায় মানুষের দুঃখ কষ্ট কেউই বুঝতে চায় না।
খাবার পানি, রান্না খাওয়া ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা একেবারে নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় বানভাসী মানুষদের খাওয়া দাওয়া একবেলা হলেও অন্যবেলায় জুটছে না। নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের বানভাসি অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন উপকূলবাসীর একটাই দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ। দেশের মানচিত্রে এই জনপদকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের বিকল্প নেই। তাই উপকূলবাসী প্রধানমন্ত্রীর কাছে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম বাপ্পি জানান, ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাতে তার বিভাগের আওতাধীন তিনটি (৪,৭/১ ও ৭/২ নং) পোল্ডারের ১৪ টি পয়েন্টের ৮টি স্থানে ৬৪০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ২৭ কিলোমিটার বাঁধ। প্রতাপনগরের কুড়িকাউনিয়, বন্যতলা ও হরিষখালী ছাড়া বাকি সবগুলো ভাঙ্গন পয়েন্ট ইতিমধ্যে মেরামত করা হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখে গেছেন। বাঁধের কাজ করার জন্য মৌখিক অনুমোদন পাওয়া গেছে। আমরা এলাকায় কাজ করছি। প্রথম থেকেই এলাকায় আমাদের লোক রয়েছে। সম্ভাবত বৃহস্পতিবার থেকে আমরা প্রতাপনগরের ভাঙ্গন পয়েন্ট মেরামতের কাজ শুরু করবো। আশা করছি আগামী আমাবশ্যা গোনের আগেই এই তিনটি পয়েন্ট মেরামত করতে পারবো।
খুলনা গেজেট/ এস আই