বিশ্ববিদ্যালয় না হয়েও যেন অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় খুলনার সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজ। শুধু খুলনা অঞ্চল নয়, সারাদেশের ঐহিত্যের প্রতীক শতাব্দীর প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন সময়ে লাখ লাখ মেধাবী শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর হয়েছে ভৈরব তীরের ক্যাম্পাসটি। নানা ঘাত প্রতিঘাতে সব সময়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্যাম্পাসের অবকাঠামোগতও পরিবর্তনও হয়েছে। তবে তার ছোঁয়া লাগেনি কলেজটির ছাত্রাবাসে। দূর-দুরান্তের হাজারো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের ছাত্রাবাসে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। এরমধ্যে কোনটি পলেস্তারা খসে পড়ছে, কোনটি ছাদ চুঁইয়ে পানি নামছে আবার কোনটি দরজা-জানালার হদিস নেই অবস্থা। ফলে জীবনকে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেছে শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি আতংকে দিন কাটাচ্ছে তারা।
কলেজের ছাত্রাবাস ঘুরে ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কলেজ ক্যাম্পাসের ৫টি ছাত্রাবাসেরই বেহাল অবস্থা। জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। ভবনের ছাদের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। এরমধ্যে বেহাল অবস্থা শহীদ তিতুমীর এবং ড. জোহা হলের। হল দুটির অনেক কক্ষের জানালা ও দরজার পাল্লা নেই। ঘুন পোকায় খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে কোন পরিত্যক্ত ভবন। হাজী মহসিন হলেরও একই অবস্থা । এ হলের বাইরের জানালার অধিকাংশ গ্লাসগুলো ভেঙ্গে গেছে। হলের ছাত্রদের অভিযোগ জীবনের ঝুঁকি ও আতংক নিয়ে তারা হলে অবস্থান করছে। তারপরে আছে মশার সীমাহীন উপদ্রব।
শহীদ তিতুমীর হল: বাইরে থেকে দেখতে পরিত্যক্ত মানের হলটিতে আসন সংখ্যা ১৪০। দ্বিতল ভবন এ হলটির ছাঁদ ও দেয়ালের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। জরাজীর্ণ ভবন। ভবনের জানালা-দরজাগুলো অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকগুলো কক্ষের জানালা ও দরজার কোন কপাট নেই। ভিতরে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। ১২ টি টয়লেটের ৬ টি অকেজো। আছে মশার উপদ্রব। ১৯৮১ সালে ছাত্রাবাসটি নির্মিত হয়। নির্মাণের পর বেশ কয়েকবার হলটি সংস্কার করা হলেও এখন আর বসবাস উপযোগী বলা যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষার্থীরা বলেন, ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় রূপ নিয়েছে। বিল্ডিংয়ের ছাঁদের টেম্পার অকেজো হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে বেশ কয়েকটি রুমে ছাঁদ দিয়ে পানি পড়ে। ভবনটি ধসে পড়ার আশংকা রয়েছে। জীবনের চরম ঝুঁকি এবং আতংক নিয়ে আমরা ভবনটিতে অবস্থান করছি।
ড.জোহা হল: ১৯৯১ সালে ছাত্রাবাসটি নির্মিত হয়। দ্বিতল ভবনের এ হলটিতে আসন সংখ্যা ৬০। তিতুমীর হলের মতো এ হলটিরও একই অবস্থা । বিল্ডিংয়ের ছাদের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। পরিত্যক্ত ভবনের মতো দেখতে ভিতরে আবাসিক হলের কোন পরিবেশ নেই। সুনশান নিরবতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলে অবস্থানকারী কয়েকজন ছাত্র জানান, বর্ষা মৌসুমে কয়েকটি কক্ষে ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। কক্ষের জানালা-দরজাগুলো ঠিক নেই। ঘুন পোকায় খেয়েছে। পানি পানের একমাত্র টিউবওয়েলটি ৩/৪ বছর অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। অসম্ভব মশার উপদ্রব। জীবনের ঝুঁকি এবং আতঙ্ক নিয়ে তাদের হলে অবস্থান করতে হচ্ছে। অতি দ্রুত ছাত্রাবাসটি মেরামত করা দরকার। ইতিপূর্বে কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার যথাযথভাবে কাজ করেনি।
হাজী মহসিন হল: এ ছাত্রাবাসটির অবস্থাও খুব শোচনীয়। ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ছাঁদ এবং ওয়ালের প্লাস্টার খসে খসে পড়ছে। ১৯৯৩ সালে ছাত্রাবাসটি নির্মিত হয়। আসন সংখ্যা ৯৬। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলে অবস্থানকারী বেশ কয়েক জন ছাত্র জানান, অসম্ভব মশার উপদ্রব। দিবারাত্রি সারাক্ষণ মশার কয়েল জ্বালিয়েও মশার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছেনা। বিল্ডিংয়ের টেম্পার নষ্ট হয়ে গেছে। জরাজীর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে আতঙ্ক এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছি।
কাজী নজরুল ইসলাম হলঃ ১৯৬৩ সালে হলটি নির্মিত হয়। হলে ঢুকতে বাম দিকে দো’চালা টিনের ছাউনি কক্ষগুলিতে ৩০ জন এবং বাম দিকে দো’চালা টালির ছাউনি কক্ষগুলিতে ৩০ ছাত্র বাস করে। ছাত্রাবাসটি নির্মাণের পর কেটে গেছে ৫৯ বছর। কিন্তু ছাত্রাবাসটি সেই একই আঙ্গিকে রয়ে গেছে। টিনের গরম সহ্য করে প্রতি কক্ষে ৪ জন করে ৬০ জন ছাত্র হলটিতে বাস করছে।
সুবোধ চন্দ্র হল: কলেজের খুবই পুরাতন এ ছাত্রাবাসটি ভৈরব নদের তীরে অবস্থিত। এ হলটিও টিনের দো’চালা। ২টি ব্লকে আসন সংখ্যা ৭৫। টিনের দো’চালা ছাউনি। রুমগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ওয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলে অবস্থানকারী এক ছাত্র জানালেন গত ৪ বছরের মধ্যে এক বার ছাত্রাবাসটি সংস্কার করা হয়েছে।
কলেজে ৩ টি ছাত্রী নিবাস রয়েছে। ছাত্রা বাসগুলোর তুলনায় ছাত্রী নিবাসগুলি কিছুটা উন্নত হলেও পর্যাপ্ত নয়। ৩ টি ছাত্রী নিবাসে আসন সংখ্যা মাত্র ২৮৮।
কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ছাত্রাবাস গুলোর ছাত্রদের দাবি পুরাতন, জরাজীর্ণ, ঝুঁকিপূর্ন ছাত্রাবসগুলো ভেঙ্গে নতুন আঙ্গিকে এগুলো নির্মাণ করা হোক।
ছাত্রাবাসগুলোর দৈন্যদশা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শরীফ আতিকুজ্জামানের কাছে, তিনি খুলনা গেজেটকে বলেন, নতুন হল নির্মাণ, হলগুলোর উন্নয়ন বা সংস্কারের জন্য কলেজের নিজস্ব কোন ফান্ড নেই। সরকার হলগুলোর উন্নয়ন এবং সংস্কারের জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। কিন্ত সেটা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা অপ্রতুল। কলেজের অনকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের পর আমার কলেজের জন্য ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। ছাত্রী নিবাসগুলোর উন্নয়ন কাজ চলছে। বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক কাজ ঠিকাদারদের কাছ থেকে বুঝে নিতে পারলে কাজগুলি উপকারে আসে। আমি অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের পর থেকে ঠিকাদারদের কাজ থেকে কাজ বুঝে নেওয়ার বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিয়েছি।
তিনি বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত সারা দেশের কলেজের যে ছাত্রাবাস বা ছাত্রী নিবাস অচল হবে সেটা আর সচল করা হবে বা নতুন কোন হল নির্মাণ করা হবে না।
খুলনা গেজেট/কেডি/এনএম