খুলনা, বাংলাদেশ | ২৫ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১০ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১০৩৩
  কুষ্টিয়ায় বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু
  আরও এক মামলায় খালাস পেলেন ফখরুল-রিজভী-আমির খসরু
  ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে রেণু হত্যা : একজনের মৃত্যুদণ্ড, ৪ জনের যাবজ্জীবন

গণহত্যায় লাশেরস্তুপে জীবিত শিশু সুন্দরী দাসীর খবর রাখেনি কেউ

শেখ নাদীর শাহ্, পাইকগাছা

মুক্তিযুদ্ধকালীন ডুমুরিয়া ট্রাজেডি থেকে উঠে আসা রাজকুমারী ওরফে সুন্দরী দাসী। সর্বহারা মানুষের ধ্বংসস্তুপ থেকে বেঁচে ফেরা পঞ্চাশোর্ধ সুন্দরী এখন পুরনো খবরের শিরোনাম। হার্ট, কিডনিসহ নানা জটিল রোগ-শোক ভর করায় উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর অফিস সহকারীর পদে তার স্থলে কাজ করছেন ছেলে সুমন। এখন আর কেউ তাঁর খোঁজ-খবর রাখেনা, সবই পুরনো হয়ে গেছে আক্ষেপের সাথে কথাগুলো বলছিলেন সুন্দরী নিজেই।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারের পশ্চিমে নরনিয়া মাদ্রাসা, হাইস্কুল থেকে শুরু করে পূর্বে মালতিয়া, কাঁঠালতলা বাজার ও উত্তরে ভদ্রানদী কালীবাড়ি পর্যন্ত অঞ্চল জুড়ে ছিল যুদ্ধ উদ্বাস্তুদের অবস্থান। ৭১ সালের ২০ মে’ সকাল ১১টা। সাতক্ষীরা সীমান্তের পাকিস্তানি বাহিনী পাতখোলা (বর্তমান চুকনগর ডিগ্রি কলেজ এলাকা) পৌঁছেই শুরু করে নিরীহ স্থানীয়দের ওপর অতর্কিত হামলা। শুরু হয় নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। মাত্র চার-পাঁচ ঘন্টার ব্যবধানেই গোটা এলাকা পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। ওই হামলায় সেখানকার অন্তত ১০/১২ হাজার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

ট্রাজেডির সাক্ষীদের অন্যতম ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের মালতিয়া গ্রামের এরশাদ আলী মোড়ল। সরেজমিনে কথা হয় তার সাথে। গণহত্যার ধ্বংসস্তুপের উদ্বৃতি দিতে গিয়ে তিনি জানান, ঘটনার পর ঐদিন বিকেল ৪টার দিকে অনেকের পাশাপাশি তিনিও উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে। নিরীহ মানুষের লাশের স্তুপ দেখে তাৎক্ষণিক হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। এরপর হুশ ফিরে লাশের স্তুপের মাঝে তিনি জীবিত অবস্থায় আবিষ্কার করেন, বছর দেড়েকের একটি শিশুকে। সারা শরীরে রক্তমাখা ক্ষুধার্ত শিশুটি তাঁর মৃত মায়ের স্তন্যপান করছে। ক্ষিপ্রগতিতে মায়ের বুক থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যান তিনি। তবে সেদিন লাশের স্তুপ থেকে জীবিত শিশুটিকে উদ্ধার করলেও বংশ-পরিচয় কিংবা গোত্র উদ্ধার করতে পারেনি। শুধুমাত্র মানবশিশু উদ্ধারে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।

এরপর দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীনের পর এরশাদ আলী মোড়ল শিশুটিকে দত্তক দেন প্রতিবেশী মান্দার দাস ও মালঞ্চ দাসী দম্পতিকে। মূলত এরপর তারাই শিশুটির নাম রাখেন, রাজকুমারী ওরফে সুন্দরী দাসী। নতুন পরিচয়ে বেড়ে ওঠা সুন্দরী।

এরপর ১৯৮৪ সালে সুন্দরীর বিয়ে হয় একই এলাকার জনৈক বাটুল সরকারের সঙ্গে। মাত্র ৬ বছরের দাম্পত্য জীবন কাটানোর একপর্যায়ে ১৯৯০ সালে আকস্মিক মৃত্যু হয় বাটুল সরকারের। এরই মধ্যে তাদের দাম্পত্য জীবনে জন্ম নেয় দু’ছেলে সুমন ও ডেভিট দাস। আবারও জীবনের ছন্দপতন।

একমাত্র অবলম্বন ছেলেদের বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শ্রমিক হিসেবে কাজ নেন ডুমুরিয়ার একটি ইটভাটায়। সুন্দরীর জীবনের ট্রাজেডির খবরে ডুমুরিয়া শিল্পকলা একাডেমিতে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরির ব্যবস্থা করেন কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে সুন্দরী উপজেলার কাঁঠালতলা আবাসনের বাসিন্দা। তবে কিডনি, হার্টসহ নানা শারীরিক জটিল রোগ ভর করেছে তার উপর।

আক্ষেপের সাথে সুন্দরীর প্রতিক্রিয়া, ১৫ বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে উপজেলার চুকনগর বাজার সংলগ্ন ১১ শতাংশ সরকারি ডোবা শ্রেণির খাসজমির বরাদ্দ হয় তার। অর্থাভাবে এখনো ভরাট করা সম্ভব হয়নি জমিটুকু। সম্প্রতি ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদ ও আটলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখ হেলাল উদ্দীন উপজেলার কাঁঠালতলা নদীর পাড়ে আবাসন প্রকল্পের একটি টিনশেডের পাকা ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন। বর্তমানে সেখানেই ঠাঁই হয়েছে তাঁর। তবে মায়ের খবর রাখেনা বেকার ছেলেরাও।

সুন্দরী জানান, ‘এখন কেউ তাঁর খবর রাখে না। পুরোনো বাসী খবরের রসদ তিনি। জানুয়ারি থেকে কিডনি, হার্টের সমস্যার পাশাপাশি কোমরের হাড়েও প্রচন্ড ব্যথা। তাই অফিসেও যেতে পারেন না। যদিও ছেলে সুমন দাস সেখানে মায়ের বদলি হিসেবে কাজ করেন। তবে তাদের সংসারও আলাদা।

এব্যাপারে ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদ জানান, ‘সম্প্রতি সুন্দরীকে আবাসন প্রকল্পের একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সেখানেই বসবাস তাঁর।’ উন্নত চিকিৎসাসহ আর্থিক সহায়তায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!