খুলনায় আব্দুল আহাদ গাজী (২৮) নামে একজন মটর সাইকেল গ্যারেজের মিস্ত্রিকে হত্যা করে লাশ গুমের অভিযোগ এনেছেন তার বৃদ্ধ পিতা মোঃ হযরত আলী গাজী। আর এ হত্যা ও গুমের সঙ্গে জড়িতরাই এখন তার ছেলের নামে থাকা ৩ কোটি টাকা মূল্যের চারতলা ভবনের বাড়িটি দখল ও বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আহাদ গাজী মহানগরীর পশ্চিম টুটপাড়াস্থ আল আমীন সড়ক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা। খুলনা শিশু হাসপাতাল এলাকায় তার মটর সাইকেলের একটি গ্যারেজ ছিল। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করে পিতা হযরত আলী খুলনার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এর আমলী আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
গত ১৩ মার্চ দায়েরকৃত মামলায় পুলিশ ও সোর্স এবং তাদের সহযোগী পরিচয়দানকারী ৭জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয়ের আরও ৩/৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাদির আইনজীবী ড. মো. জাকির হোসেন।
এজাহারে উল্লিখিত আসামিরা হচ্ছে- পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী মাগুরা জেলা সদরের আলোকদিয়া গ্রামের সাহেস আলী মিয়ার পুত্র সাঈদ আহমেদ, একই জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার মিয়া বাড়ী’র সাইফুর রহমানের পুত্র মোঃ লিটন মিয়া, খুলনা মহানগরীর বাগমারা মেইন রোড (গফফারের পানের দোকানের মোড়) এলাকার মৃত সবেদ আলী সরদারের পুত্র মোঃ হারুন-অর-রশিদ ও তার পুত্র মোঃ মিম, নগরীর ইউসুফিয়া মসজিদ রোডস্থ বড় মির্জাপুর এলাকার বাসিন্দা মোঃ রাসেল খন্দকার এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার এবং পশ্চিম টুটপাড়া পুরাতন পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা মৃত এ্যাডঃ আঃ হাই’র পুত্র কামরান হাসান।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, হযরত আলী গাজী’র পুত্র আব্দুল আহাদ গাজী’র মটর সাইকেলের গ্যারেজে আসামীরা নিয়মিত মটর সাইকেলের কাজ করাতেন। এছাড়াও সে খুলনা সিএমএম কোর্ট থেকে নিলামে পুরাতন মটর সাইকেল ক্রয় করে তার গ্যারেজে নিয়ে মেরামত করে বিক্রির ব্যবসা করতো। সেই সুবাধে আসামীগণের সাথে ভিকটিমের সু-সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে আসামীগণ তার বাড়ীতে যাতায়াতও করিত। সর্বশেষ গত বছরের ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে পুলিশ পরিচয়ে মোঃ লিটন মিয়া ও মোঃ রাসেল খন্দকার আব্দুল আহাদ গাজীকে তার বাড়ী থেকে কৌশলে ডেকে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে সে আর বাড়ীতে ফিরে আসেনি। এ অবস্থায় ছেলেকে না পেয়ে বৃদ্ধ পিতা হযরত আলী গাজী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে খোঁজ-খবর নিয়েও পুত্রকে না পেয়ে তিনি ১৪ মে খুলনা থানায় একটি সাধারন ডায়েরী করেন। পরবর্তীতে তিনি পুত্রের সন্ধান চেয়ে পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেন। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় এক বছর হতে চললেও তার সন্ধান মেলেনি।
অপরদিকে পুত্র আব্দুল আহাদ গাজীকে খুঁজে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নিজেদের পরিচয় গোপন করে আসামি মোঃ লিটন মিয়া ও মোঃ হারুন-অর-রশিদ বাদীর বাড়ীতে ভাড়াটিয়া হিসেবে ঘর ভাড়া নেয়। এর কিছুদিন পরই নিজেকে পুলিশের এসআই পরিচয় দিয়ে প্রথমে লিটন মিয়া নিখোঁজ আব্দুল আহাদ গাজী’র কাছে ৫০ লাখ টাকা পাওনা আছে বলে তার বৃদ্ধ পিতা হযরত আলী গাজী’র কাছে দাবি করেন। সেই টাকার বিনিময়ে আহাদের নামের চারতলা ভবনের একটি ফ্লাট তার নামে লিখে দেওয়ার জন্য বৃদ্ধ হযরত আলীকে চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। এছাড়া সে ওই ভবনে ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠলেও ভাড়া না দিয়ে জোরপূর্বক বসবাস করছে।
এর কিছুদিন যেতে না যেতেই অপর আসামি সাঈদ আহমেদ নিখোঁজ আব্দুল আহাদ গাজী’র কাছে ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাওনা আছে বলে তার বৃদ্ধ পিতা হযরত আলী গাজী’র কাছে দাবি করেন। একইভাবে তিনিও ওই টাকার বিনিময়ে অন্য একটি ফ্লাট লিখে নেওয়ার জন্য বাদীকে নানাভাবে হুমকি প্রদর্শন করেন। একইভাবে অপর আসামি মোঃ হারুন-অর-রশিদ নিজেকে পুলিশ ইন্সপেক্টর পরিচয়ে নিখোঁজ আব্দুল আহাদ গাজী’র কাছে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা পায় বলে দাবী করে এবং তার ছেলে অপর আসামি মিম’র নামে বাড়ীর একটি ফ্লাট জোরপূর্বক অরেজিষ্ট্রিকৃত স্ট্যাম্পে লিখে দিতে বাধ্য করে। ফ্লাটের মূল্য সাড়ে ১৯ লাখ টাকা হলেও আসামি হারুন তার মূল্য নির্ধারন করেন ১৫ লাখ টাকা। এভাবে কম মূল্য দেখিয়ে তিনি অবৈধভাবে জোর করে একটি ফ্লাট লিখে নেন।
একইভাবে অপর আসামি কামরান হাসান বাদীর পুত্রের নিকট দেড় লাখ টাকা পায় বলে দাবি করে। সে মতে পুলিশ ইন্সপেক্টর পরিচয়দানকারী হারুন-অর-রশিদের উপস্থিতিতে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে নিখোঁজ আব্দুল আহাদ গাজী’র বৃদ্ধ পিতার কাছ থেকে ওই দেড় লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। একই পথ অনুসরণ করে পুলিশ সদস্য পরিচয়ে মোঃ রাসেল খন্দকার এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার বাদীর ছেলের কাছে ৩ লাখ টাকা পায় দাবী করে। একইসঙ্গে পুলিশী ভয়-ভীতি দিয়ে এ টাকা তারা বাদীর কাছ থেকে প্রতিমাসে ১০/২০ হাজার টাকা করে দিতে বাধ্য করে।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, নিখোঁজ পুত্রের নামে থাকা বাদীর চারতলা ভবন বিশিষ্ট বসত বাড়ীটি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড খুলনা শাখায় মর্টগেজকৃত রয়েছে। আসামিরা বিষয়টি অবগত থাকায় বাদীর ৩ কোটি টাকা মূল্যের চার তলা বাড়িটি দখলের জন্য আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড খুলনা শাখার ২/১ জন অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে বাদীর পুত্র আব্দুল আহাদ গাজীকে অপহরণ করে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। এখন পরস্পর যোগসাজসে প্রতারণার মাধ্যমে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড খুলনা শাখার সহায়তায় আসামিরা অর্থ আত্মসাৎ ও বাড়িটি দখলের ষড়যন্ত্র করছে। যার অংশ হিসেবে তার কাছে মোটা অংকের অর্থ পাবে- মর্মে দাবি করে ফ্লাট লিখে দিতে বাধ্য করছে।
ছেলে হারিয়ে পাগলপ্রায় মামলার বাদি বৃদ্ধ হযরত আলী গাজী এ প্রতিবেদককে বলেন, তার ছেলে থাকাকালীন কেউ তার কাছে বা বাড়িতে গিয়ে একটি টাকাও পাবে বলে দাবি করেনি। কিন্তু ছেলে নিখোঁজের পর থেকেই পুলিশ, সোর্স ও সহযোগি পরিচয়ে প্রতিনিয়ত তার কাছে টাকা দাবি করা হচ্ছে।
একদিকে তিনি নিজে অসুস্থ্য তারও নিখোঁজ ছেলের একমাত্র শিশু পুত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, অন্যদিকে একের পর এক আসামিদের টাকা-ফ্লাট লিখে নেওয়ার দাবিতে ভয়ভীতি ও হুমকিতে চরম আতংকিত হয়ে পড়েছেন। এতে তার বৃদ্ধ স্ত্রীও অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে তিনি খুলনা সদর থানা পুলিশের কাছে বার-বার ধর্ণা দিয়েও কোন প্রতিকার পাননি। এমনকি লিখিত অভিযোগ করেও কাজ হয়নি। ফলে বাধ্য ও নিরুপায় হয়ে ন্যায় বিচারের দাবিতে আদালতের স্মরণাপন্ন হয়েছি। তিনি নিখোঁজ পুত্রের সন্ধান এবং উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃস্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
বাদির আইনজীবী ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, এজাহারভূক্ত আসামিরা বাড়ি ও বাদির কাছ অর্থ হাতিয়ে নিতে নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে পুলিশের ভাবমূর্ত্তি ক্ষুন্ন করেছে। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ১৫ মে মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে। অসহায় ও ছেলে হারা পিতা আদালতের কাছে ন্যায় বিচার পাবেন বলে তিনি আশা করছেন।
খুলনা গেজেট/কেডি