খুলনা, বাংলাদেশ | ২৫ বৈশাখ, ১৪৩১ | ৮ মে, ২০২৪

Breaking News

  প্রথম ধাপের উপজেলা ভোট শেষ, চলছে গণনা
  উপজেলা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ : রিজভী
  তেঁতুলিয়ার খয়খাটপাড়া সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত

করোনার চ্যালেঞ্জ : সমাজ সংস্কৃতি অর্থনীতি রাজনীতি

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

করোনাভাইরাস আমাদের জীবনযাত্রাকে পাল্টে দিয়েছে। পরিবারের সবাই এখন এক সঙ্গে। যারা এতদিন পরিবারকে সময় দিতে পারেননি, তারা এক অখন্ড অবসর পেয়েছেন। অনেক স্বামী স্ত্রীকে সময় দিচ্ছেন, গৃহকর্মে সহায়তা করছেন, একসঙ্গে সন্তানদের সঙ্গে গল্প করছেন, এক ধরনের সুখী জীবন-যাপন করছেন। কিন্তু অনেক পরিবারে সঙ্কটও তৈরি হচ্ছে। যারা সর্বদা বাইরে ঘুরতে অভ্যস্ত তারা ঘরে বসে হাঁপিয়ে উঠছেন। পরিবারে অশান্তি তৈরি হচ্ছে। অনেক স্ত্রী সকাল-সন্ধ্যা গৃহকর্মে গলদঘর্ম, অন্যদিকে স্বামী টেলিভিশনের সামনে বসে কিছুক্ষণ পর পর চা-নাস্তার ফরমায়েশ করছেন। খাবার খেতে আধ ঘণ্টা দেরি হলে তুলকালাম কান্ড তৈরি হচ্ছে। তাই করোনা কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবারের বন্ধনকে সুদৃঢ় করছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিবারগুলো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। সন্তানরা অনেক ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজ করছে। আবার অনেকে ‘ইউটিউবে’ আপত্তিকর বিষয়াবলীর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফলে অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদেরও টানাপোড়েন তৈরি হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও পারিবারিক বিপর্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

পরিবারের বাইরেও আমাদের সামাজিকতার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। গত তিন মাসে কেউ কারও বাড়িতে বেড়াতে যায়নি। বাসায় বা বাড়িতে কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অবশ্য গ্রামের চিত্র পুরোপুরি এমনটা নয়। কিছু ক্ষমতাশালী বিত্তবান মানুষের মধ্যে এই করোনাকালেও সামাজিকতা বজায় ছিল -যা পত্রিকান্তরে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত। সাধারণভাবে কেউ অন্য কারও গৃহে বেড়াতে বা চা খেতে পর্যন্ত যাচ্ছে না।

করোনাভাইরাসে নিকটাত্মীয় মৃত্যুবরণ করলে তার কাছে যাবার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে অনেকের স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও স্বজনরা কাছাকাছি যেতে ভয় পাচ্ছেন। করোনার লক্ষণ দেখে সন্তানরা মাকে ফেলে দিচ্ছে। আবার অন্য কেউ ঐ ফেলে দেয়া নারীকে নিজের মা হিসেবে গণ্য করে আশ্রয় দিয়েছেন। স্বামীর করোনায় স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আবার স্বামীও একই ক্ষেত্রে স্ত্রীর প্রতি বিরূপ আচরণ করছেন। পিতা-মাতার মৃত্যুর পরে সন্তানরা তাদের লাশ শনাক্ত পর্যন্ত করতে হাসপাতালে যাচ্ছে না। অনেকে গাড়িতে বসে থেকে শুধু ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কারণ এটি দিয়ে তাদের পেনশন ভোগ করা যাবে। করোনার অভিঘাতে সমাজের এই বিচিত্রতা আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে, কেউ জানে না।

করোনা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রা অনেক ক্ষেত্রে পাল্টে যাচ্ছে। গরিবের চেয়ে ধনীর ওপর এই ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি। জৌলুস ও আড়ম্বরবিহীনভাবে যে জীবন পরিচালনা করা যায়, তা অনেকেই অনুধাবন করছেন। করোনাত্তীর্ণ অনেক মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন পত্র-পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে অনেকে বলেছেন যে, বহু বছর ধরে তারা ব্যবসা বা সম্পদের পেছনে ছুটেছেন, কিন্তু এ সময়ে তারা পরিবারকে সময় দিয়েছেন, আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিয়েছেন; এবং সর্বোপরি জীবনকে নতুন করে উপলব্ধি করেছেন। অনেক বড় ব্যবসায়ীর মতামত এরকম যে, বাকি জীবন মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে ধন্য হব। কিন্তু অনেকের মধ্যে সেই উপলব্ধি নেই। রক্তের প্রতিটি কণায় যাদের অসততা এবং লোভ, তারা পরিবর্তন হবে এটি আশা করা যায় না। যারা মানুষকে ফাঁদে ফেলে আনন্দ পায় বা লাভবান হয়, তাদের কোন পরিবর্তন হয়েছে কি না জানা যায় না। যারা ঘুষ খায় তারা ঘুষ বন্ধ করেছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। তাদের কোন উপলব্ধির খবর কোথাও নেই। করোনা নিয়ে ব্যবসা ও প্রতারণা হয়েছে। নিম্নমানের পিপিই ও মাস্ক সরবরাহ করে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম চালানে যে মাস্ক সরবরাহ করা হয়, তার প্যাকেটের ওপরে লেখা ছিল ‘এন-৯৫ মাস্ক’। কিন্তু ভেতরের মাস্কগুলো ছিল ‘কে এন-৯৫’। আমরা জানতে পেরেছি যে, এন-৯৫ মাস্ক শুধু ইউএসএ’তে তৈরি হয়। কিন্তু কেএন-৯৫ মাস্কের গায়ে কোম্পানির নাম ঔগও, উৎপাদন স্থল লেখা ছিল গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ, বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণে হাসপাতালের পরিচালক এ. টি. এম মঞ্জুর মোরশেদ উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে ফোন করে বিষয়টি অবহিত করেন এবং তার করণীয় জিজ্ঞাসা করেন। এই ‘অপরাধে’ তাকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়। তিনি খুলনারই মানুষ। সজ্জন এবং অন্যকে সহায়তা করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু তার এভাবে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটল। যারা বিষয়টি শুনেছেন এবং জানেন তারা কি ভেবেছেন তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ‘সব দোষ নন্দ ঘোষ’। সবকিছু শেষ পর্যন্ত বর্তায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর। তাঁর এই যে ত্যাগ, এই যে কঠোর পরিশ্রম; মানব কল্যাণে তার যে নিরন্তর প্রয়াস, সব যেন ফিকে হয়ে যায়। আমাদের মতো মানুষকে বিভিন্ন দায়িত্ব দেয়ার পর আমরা যদি দুর্নীতি বা অনিয়ম করি তার দায় তিনি কেন নেবেন? কিন্তু গালাগালটা তাকে উদ্দেশ্য করেই যেন করা হয়। আর আমরা ঐ দায়িত্বপ্রাপ্তরা নির্লজ্জের মতো সেগুলোকে হজম করি। করোনা আমাদের ক্লান্ত করে না, আমাদের মধ্যে অনুশোচনা জাগায় না; আমাদের লোলুপ জিহ্বা আরও সম্প্রসারিত হয়। আমরা জমজমাট ‘করোনা ব্যবসায়’ মত্ত হয়ে উঠি। প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে এতজন দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্যকে সামলানো কঠিন। সেজন্য সমি¥লিত প্রয়াস প্রয়োজন। সচেতন জনগোষ্ঠী, সংবাদ মাধ্যমসমূহ এ বিষয়গুলোকে যত সামনে আনবে ততোই দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করা সম্ভব। করোনায় অসৎ, দুর্নীতিবাজ, অর্থলোলুপ ও চরিত্রহীনদের জীবনে কোন পরিবর্তন নিয়ে আসেনি। উল্টো অনেক ভাল মানুষ এরমধ্যে ইহজীবন ত্যাগ করেছেন। কারণ তারা নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশের জনগণের জন্য নিবেদিত ছিলেন। করোনা যদি একটা একটা করে ঐ দেশবিরোধী মানুষগুলোকে ধরতো, তাহলে একটা নিষ্কলঙ্ক সমাজ তৈরি হতে পারতো। দুর্ভাগ্যবশত তা হচ্ছে না।

করোনাকালে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনেক নতুন নতুন উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। করোনাকে কেন্দ্র করে অনেক কবি কবিতা লিখছেন, গান লিখছেন অনেক গীতিকার। ইতোমধ্যে অনেকে গল্পও লিখেছেন। ‘আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে’ অথবা ‘দাদা, আমি সাতে পাঁচে থাকি না’ অনলাইনে বাংলা কবিতা দুটি বেশ প্রচার পেয়েছে। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীও কবিতা লিখেছেন। অনেকে আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। অনেক বিজ্ঞাপনী সংস্থা করোনাকেন্দ্রিক নতুন বিজ্ঞাপন তৈরি করেছে। একসময় হয়তো ‘করোনাকালের সাহিত্য’ নিয়ে গবেষণা হবে। প্রান্তিক মানুষকে সাহায্যের জন্য বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার তাদের খেলার সামগ্রী নিলামে তুলেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ একটি কাব্যের পান্ডলিপিও নিলামে তোলেন। যথারীতি এটি সম্মানজনক মূল্যে বিক্রি হয়। সমাজে যে কাব্যপ্রেমী মানুষ আছে এবং মানুষ মানুষের জন্য এতে তার প্রতিফলন ঘটে। জয়নুল আবেদীনের চিত্রকর্মও নিলামে উঠেছে।

মানুষকে আনন্দ দেয়ার জন্য অনেক শিল্পী এই সময়ে ঘরে বসে খালি গলায় গান গেয়ে ফেসবুকে দিচ্ছেন। গৃহকোণে থেকে মানুষ কত ধরনের সৃজনশীল কর্মকা- সম্পন্ন করেছে তার ইয়ত্তা নেই। এ সময় মানুষ বেশি পরিমাণে ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এটাকে অনলাইন সংস্কৃতি বলা যেতে পারে। যেহেতু ঘরের বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না তাই অনেকে কেনাকাটা সারছেন অনলাইনে। বিশেষ করে বইপত্র যোগাড় করা সহজ হয়েছে। নতুন করে নাটকের শুটিং হচ্ছে না। সিনেমা বানানো বন্ধ রয়েছে। সিনেমা হল বা মঞ্চ কোনকিছুই খোলা নেই। কলাকুশলীদের জীবনযাপন দুরূহ হয়ে পড়ছে। এদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন সাংগঠনিক প্রণোদনা আছে, কিন্তু এর মাধ্যমে দীর্ঘকাল জীবনযাত্রা সম্ভব নয়। কয়েকমাস ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরাসরি অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ ছিল। ফলে শিল্পীরা এসব ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পোশাক আশাকের ক্ষেত্রেও এক নতুন সংস্কৃতি চালু হচ্ছে। মাস্ক পোশাকের অংশ হয়ে যাচ্ছে। গ্লাভস পরিধান করা যাদের অভ্যাস ছিল না, তারাও এখন সেটা শুরু করেছে। নিজেদের রক্ষার জন্য চিকিৎসক ছাড়াও অন্যান্য পেশার অনেকেও ভাইরাস প্রতিরোধী পোশাক ব্যবহার করছে। ভবিষ্যতে মাস্ক, গ্লাভসের জায়গাগুলো হেজাব-নেকাব দখল করে ফেলতে পারে। বারংবার হাত ধোয়ার তাগিদের কারণে এ বছর অবিশ্বাস্যভাবে ডায়রিয়া কমে গেছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন হচ্ছে। একটি রোগ বা একটি ভাইরাস মানুষের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থাকে পাল্টে দিচ্ছে।

করোনার আর্থিক প্রভাব ব্যাপক। বড় বড় শিল্প-কারখানা দীর্ঘদিন বন্ধ থেকেছে। গার্মেন্টসগুলো খোলা হলেও বিদেশের অনেক অর্ডার ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে। গণপরিবহন চলেনি প্রায় ৩ মাস। দেশের সকল উন্নয়ন কাজ প্রায় বন্ধ। এই উন্নয়নের কাজের সঙ্গে শুধু অবকাঠামো নির্মাণের ধীরগতি নয়; এর সঙ্গে অসংখ্য শ্রমিকের জীবন-জীবিকার বিষয়টি যুক্ত রয়েছে। গ্রামের মানুষ যে সকল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বা সরকারী কাজের বাইরেও ব্যক্তিমালিকানাধীন উন্নয়ন কর্মকা-ও বন্ধ ছিল। কর্পোরেট ব্যবসার অনেক কিছুরই ছিল স্লথ গতি। শহরে দিনমজুর রিক্সাচালক বা এ ধরনের যানবাহনও ছিল বন্ধ। ফলে এর সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কোন কাজ নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশে অবস্থান করা কিছু জুতা পালিশ করা মানুষ, চা বিক্রেতা বা ফল বিক্রেতা সবারই কাজ বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে মানুষ দিশেহারা। প্রধানমন্ত্রী ঈদের আগে পঞ্চাশ লাখ মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। অনেক মানুষের হাতে ত্রাণও পৌঁছেছে। কিন্তু সরকারী, ব্যক্তিগত বা সামাজিক সহায়তায় কিন্তু এই কোটি কোটি পরিবার দীর্ঘদিন চলতে পারবে না। সেক্ষেত্রে সুচিন্তিত পরিকল্পনা থাকা দরকার। সাধারণভাবে যখনই দেশে বন্যা বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তখন সরকার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ভিজিএফ বা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী শুরু করে। কিন্তু এর আওতায় সব মানুষ আসতে পারে না। কিছু মানুষ আছে যারা কোনভাবেই এর আওতায় আসতে ইচ্ছুক নয়। ফলে ঐ পরিবারগুলো বেশি অভাবের মুখোমুখি হয়।
দেশে গত কয়েক মাসে সকল চাকরির বিজ্ঞাপন বন্ধ ছিল। স্বাস্থ্যখাত ব্যতিরেকে সরকারী-বেসরকারী কোন খাতেই নতুন নিয়োগ হয়নি।

বিদেশ থেকে প্রায় ১২ (বারো) লাখ কর্মী দেশে ফিরে এসেছে। এই মানুষগুলোর রেমিট্যান্স আসা বন্ধ হয়েছে এবং তারা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করত অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদেরকে নিকট ভবিষ্যতে ফেরত নেবে কিনা, তা বলা দুষ্কর। ফলে নিয়মিত বেকারের পাশাপাশি একটা বড় সংখ্যক অনিয়মিত বেকার তৈরি হচ্ছে। এ জন্য এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা থেকে যায়। যে সকল তরুণ দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তারা না পারবেন কৃষি কাজ করতে, না পারবেন এ ধরনের অন্য কোন কাজে অংশগ্রহণ করতে। এ জন্য তাদের পরিবারগুলো মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পতিত হবে। এরই মধ্যে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে ঘোষণা আসছে যে, তারা তাদের কর্মী সংকোচন করবে। এটিও শ্রমজীবী মানুষের ওপর বড় ধরনের আঘাত। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতির অবসান কবে হবে তা কেউ জানে না। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী লকডাউন বা সাধারণ ছুটিকে হ্রাস করে সীমিতভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে বড় ধরনের প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শুরু করা না গেলেও সাধারণ কেনাবেচা শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে হয়তো অর্থনীতির চাকা গতিশীল হবে। কিন্তু তারপরও সব সেক্টরের সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ এবং বড় বড় বেসরকারী সংস্থা বা সংগঠনের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, যখনই প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সেক্টরে প্রণোদনার ঘোষণা দিলেন, তখন এমন সব সংগঠনের নাম সামনে এলো যে, মানুষ আসলে জানেও না যে, জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা কতটুকু। আবার এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন যিনি আগে থেকেই ঋণ খেলাপী। এমনকি এক কোটি টাকার জমিকে পাঁচ কোটি টাকা দাম দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণও নিয়েছেন। তার সমস্ত সম্পদ বিক্রি করেও গৃহীত ঋণের একপঞ্চমাংশ পরিশোধ করতে পারবেন না। এরকম অসৎ ব্যবসায়ীও এই প্রণোদনার সুযোগ নেবেন। এতে ঐ ব্যক্তি লাভবান হলেও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন অনেক উদাহরণ আছে যে, ছোট ব্যবসায়ী অল্প ঋণ নিয়ে খেলাপী হয়েছেন। তখন ব্যাংক তার ওপর খড়গহস্ত হয়ে তার সম্পত্তি নিলামে তোলে। কিন্তু যাদের শত শত কোটি টাকা অবৈধ ঋণ তাদের স্পর্শ করে না। এই অবিচার বন্ধ করা গেলে অর্থনীতি একটা ইতিবাচক জায়গায় আসতে পারে।

করোনার পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখার জন্য সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিকভাবে সবকিছু তদারক করছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের পারফরম্যান্স ও কর্মকা- বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জনগণকে সচেতন করার জন্য পুলিশের পাশাপাশি সরকার সেনাবাহিনী নামিয়েছে। এ জন্য অনেক পুলিশ ও সেনা সদস্য আক্রান্ত হন। ইতোমধ্যে বেশকিছু পুলিশ ও সেনা সদস্যের মৃত্যুর খবরও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। করোনার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি এসেছে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীদের ওপর। শুরু থেকেই একের পর এক ডাক্তার আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, প্রথমদিকে অনেক ডাক্তার কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁরা তখন সুরক্ষা সামগ্রীর দাবি তোলেন। এটা ঠিক যে, এ ধরনের ভাইরাস আক্রান্ত রোগী নিয়ে কাজ করতে গেলে সুরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু পত্রিকায় ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যে পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে তা ভাইরাস মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট নয়। তারপরও বিপুল সংখ্যক ডাক্তার কাজ করে যেতে বদ্ধপরিকর। বিএমএ, স্বাচিপ সম্মিলিতভাবে কাজ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। করোনার কারণে কৃষকদের বোরো ধান কাটতে সমস্যা তৈরি হয়। সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে হাওড় এলাকার ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য যন্ত্রের ব্যবস্থা করে। তদুপরি প্রশাসনের সহযোগিতায় বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটা শ্রমিক অন্যান্য জেলায় প্রেরণ করা হয়। ছাত্রলীগ-যুবলীগ সারাদেশে কৃষককে ধান কাটতে সাহায্য করে। ফলে প্রায় ১৫ দিনের মধ্যে ধান কাটা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।

‘আম্ফানে’ উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের প্রচুর ক্ষতি হয়। তারপরও যে আম অবশিষ্ট থাকে তা নিয়ে আমচাষীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কারণ আমগুলোর বাজারজাতকরণ এবং তার যথাযথ মূল্য প্রাপ্তি বিষয়ে অনিশ্চয়তা। কিন্তু এক্ষেত্রেও সরকার আমচাষীদের সুবিধার্থে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রাজশাহী থেকে ‘ম্যাঙ্গো স্পেশাল’ ট্রেন সপ্তাহে একাধিকবার আম পরিবহন করে। এতে আমচাষীরা অত্যন্ত খুশি। শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন উদ্যোগ ইতোমধ্যেই উল্লিখিত হয়েছে। মাধ্যমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষা এবং ব্যবহারিক ক্লাস ব্যতীত তাত্ত্বিক বিষয়ের ক্লাসগুলো অনলাইনে সম্পন্ন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও এটি শুরু হয়েছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। কিন্তু তারপরও করোনাকেন্দ্রিক রাজনীতি থেমে নেই। তবে এই রাজনীতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও টেলিভিশনে। সরকার যা-ই করছে তার সবকিছুর সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং ইতোমধ্যে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই মৃত্যু ও আক্রান্ত নিয়ে ফেসবুকে একটি গোষ্ঠী যে ভাষা ব্যবহার করছে তা মানবিক নয়। কোন ব্যক্তির ভুলত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু এভাবে যারা কথা বলতে পারে তারা বাংলাদেশের নাগরিক দাবি করতে পারে না। করোনার শুরু থেকেই বিএনপি-জামায়াত শিবির সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাতে থাকে। করোনাকালেও জামায়াত-শিবির বেশি তৎপর। বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের কর্মকান্ড তারাই সমন্বয় করে।

করোনা পরিস্থিতি পার হলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব সহজে স্বাভাবিক হবে তা বলা যায় না। ফলে গর্তে লুকিয়ে থাকা গোষ্ঠী অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সুযোগ নিতে পারে। তারা বহুভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে। মাঠে নেই বলে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, তারা নিঃশেষ হয়ে গেছে। বরং তাদের নেটওয়ার্কিং অনেক শক্ত এবং দেশে বিদেশে তাদের প্রচারণা তুঙ্গে। সুযোগ পেলে রাজাকারের সব বাচ্চা-কাচ্চা দেশে ঢুকে পড়বে এবং প্রগতিশীল মানুষদের হত্যা করবে। গত দশ বছরে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যতটা হয়েছে, আদর্শিক প্রচার সেভাবে হয়নি। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের আদর্শ কি, কেন এই সংগঠন সমর্থন করি তার তাত্ত্বিক দিক তরুণদের মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বরং জামায়াত-শিবির নেপথ্যে থেকেও সক্রিয় থেকেছে। তাই করোনা পরবর্তী অর্থনীতি-সাংস্কৃতিক ভাবনার বাইরেও রাজনীতি নিয়ে বিশেষ ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।

করোনা ছাড়াও পৃথিবীতে মহামারী এসেছে। মানুষ প্রত্যেকবারই এ মহামারী অতিক্রম করেছে এবং বিজয়ী হয়েছে। বাংলাদেশও অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবেলা করেছে। এদেশের মানুষের প্রাণশক্তি এতবেশি যে, তারা সহজেই সকল বাধাকে অতিক্রম করতে পারে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ, রিক্সাওয়ালা বা শ্রমজীবী মানুষ করোনাকে ভয় পায় না। তাদের বক্তব্য হলো- ‘এসব সর্দি কাশি জ্বর আমাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। যারা সবসময় এসিতে থাকে তাদের জন্য এটি সমস্যা।’ মানুষের এই অফুরন্ত প্রাণশক্তিই করোনাকে পরাজিত করবে।

(লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)

খুলনা গেজেট/এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!