খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ ফাল্গুন, ১৪৩১ | ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  নাইকো দুর্নীতি মামলা : খালেদা জিয়াসহ ৮ আসামিকে খালাস
  ২৭তম বিসিএসে বঞ্চিত ১১৩৭ জনের চাকরি ফেরত নিয়ে রায় বৃহস্পতিবার
  কুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে ক্লাস পরীক্ষা
  হামলার ঘটনায় কুয়েট ভিসি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাছুদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে শিক্ষার্থীদের দ্বারা অবরুদ্ধ

আজ সুন্দরবন দিবস : অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনে বিপদে বনের প্রাণ-প্রকৃতি

এ এইচ হিমালয়

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনটি মায়ের মতো আগলে রেখেছে উপকূলের মানুষকে। তাই তো সুন্দরবনের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আজন্মের।এই স্বীকৃতি দিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্বজুড়ে ভালোবাসার দিনটি ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করে উপকূলের মানুষ। সেই হিসেবে আজ ২৫তম সুন্দরবন দিবস পালন হচ্ছে উপকূলের জনপদে।

এদিকে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনে বিপদ বাড়ছে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির। সুন্দরবন ভ্রমণে বাড়ছে ভ্রমণপিয়াসীদের ঝোঁক। সেখানে প্রতিবছর ছুটছেন দেশি-বিদেশি লাখ লাখ পর্যটক। মানুষের এই আগ্রহকে সামনে রেখে এগিয়ে এসেছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। গেল ছয় বছরেই সুন্দরবন ভ্রমণে পর্যটক টানতে যুক্ত হয়েছে ২৯টি বিলাসবহুল নৌযান। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসব নৌযানের কোনো কোনোটিতে সুইমিংপুলসহ তিনতারকা মানের সেবা দেওয়া হয়। এর পেছনে লগ্নি হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

তবে সুন্দরবনে পর্যটকের পদচারণায় বনের জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। বিপন্ন হচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি। অতিরিক্ত নৌযান ও পর্যটকের চাপ বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যাতে ক্ষতি না করে, এ জন্য ২০১৪ সালে সুন্দরবন ভ্রমণ নীতিমালা তৈরি করা হয়। এতে বনের অভয়ারণ্যের ওপর চাপ কমিয়ে প্রান্তসীমায় নতুন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার পাশাপাশি জোর দেওয়া হয় প্রকৃতিবান্ধব পর্যটনে। তবে নীতিমালা উপেক্ষা করে এখন দৈনিক গড়ে ৩০টি নৌযান অভয়ারণ্যে দিনভর অবস্থান করে। ইকোট্যুরিজমের কথা বলা হলেও বন ভ্রমণের নামে পিকনিক পার্টি বসে নৌযানে।

বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পুরোটাই সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এর ৫৩ শতাংশ এলাকাকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে সম্পদ আহরণ ও বনজীবীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। সুন্দরবনের ভেতরে বন বিভাগের ১১টি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে অভয়ারণ্য এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে চারটি।

গেল ২৫ বছরে সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ সময় পর্যটক দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ গুণ। ২০০১-০২ অর্থবছরে বন ভ্রমণ করেছিলেন ৫৯ হাজার ১৬৯ পর্যটক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ লাখ ১৬ হাজার ১৪৩ জন এবং পরের বছর বন ভ্রমণে যান ২ লাখ ১১ হাজার ৫৭ জন। গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ১ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৯ জন পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে গেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, পর্যটকের সুন্দরবনযাত্রা এবার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।

এদিকে ভরপুর পর্যটন ব্যবসার আড়ালে চাপা পড়ছে পর্যটকের নিরাপত্তার বিষয়। সুন্দরবন উপকূলে চলাচল-নিষিদ্ধ নৌযানে মেটানো হচ্ছে পর্যটকের ভ্রমণ-তৃষ্ণা। ট্রলার, জালি বোটে বনের গহিনে চলে যাচ্ছেন পর্যটক। আবার বনের ভেতর কোনো পর্যটক হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হলে সে ব্যক্তিকে উদ্ধারের কোনো পথ নেই।

সুন্দরবন ভ্রমণের উপায় দুটি। এক, দিনের মধ্যে প্রান্তসীমায় থাকা পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে দেখা। অন্যটি, বনের গহিনে ঘুরে বেড়াতে পর্যটকবাহী নৌযানে তিন দিনের সফর। এক দিনের জন্য সাধারণত ছোট ট্রলার ও জালি বোট ব্যবহার করা হয়।

সুন্দরবনে পর্যটনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমা বেগম। তিনি বনের প্রান্তসীমায় থাকা পর্যটনকেন্দ্রে দৈনিক ৪ হাজার ২১৬ জন পর্যটক থাকলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না বলে সুপারিশ দিয়েছিলেন। তবে তা আমলে নেওয়া হয়নি।

তাঁর গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, যে ট্রলার বা জাহাজে সুন্দরবনে মানুষ ভ্রমণ করে, সেগুলোর শব্দে বন্যপ্রাণী প্রজননে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। এতে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া ওই শব্দের কারণে যেসব প্রাণী (বাদুড়, ডলফিন) শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে চলাফেরা করে, তাদের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। এতে তারা ওই এলাকা থেকে চলে যেতে পারে।

অধ্যাপক ড. সালমা বেগম বলেন, সুন্দরবনে একটি জটিল ও সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্র বিদ্যমান। পরিবেশের কোনো উপাদানের সামান্যতম তারতম্য হলে ওই প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ে। বর্তমানে সুন্দরবনে যে পর্যটন ব্যবস্থা চলছে, তা কোনোভাবেই পরিবেশসম্মত নয়।

 

সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন খুবির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তিনি বলেন, ইকোট্যুরিজমের নামে যা করা হয়, তা শেষ পর্যন্ত পরিবেশসম্মত থাকে না। বেশির ভাগ পর্যটক এমন সংবেদনশীল জায়গায় কী ধরনের আচরণ করা উচিত, তা বোঝেন না। এটি বনের জন্য ক্ষতিকর। তিনি আরও বলেন, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে উন্মুক্ত পর্যটনের সুযোগ কম রাখা দরকার। মানুষ যে পারফিউম-কসমেটিকস ব্যবহার করে, এর ঘ্রাণ প্রাণীরা অপছন্দ করে। এতে তাদের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বনে মোট পর্যটকের প্রায় ৮০ শতাংশ এক দিনের জন্য করমজল, হারবারিয়া, কলাগাছিয়াসহ জনপদের কাছের পর্যটনকেন্দ্রে যান। নতুন পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের পর করমজলসহ অন্য কেন্দ্রের ওপর চাপ কমেছে। তবে অভয়ারণ্যের মধ্যে থাকা কটকা, কচিখালী, নীলকমলে (হিরণ পয়েন্ট) আগের চেয়ে চাপ বেড়েছে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানান, নৌযানে যারা বনের ভেতর যান, তাদের প্রথম পছন্দ থাকে কটকা বা জামতলা বিচ; দ্বিতীয় পছন্দ নীলকমল অভয়ারণ্য। পর্যটক ধরে রাখতে ট্যুর অপারেটররা এসব স্থানে যাবেনই। পাঁচ বছর আগে ৩৫ থেকে ৪০টি নৌযানে পর্যটক অভয়ারণ্য এলাকায় যেতেন। এখন ৬৮টি লঞ্চের প্রতিটি সপ্তাহের দু’দিন ওই এলাকায় যায়।

ট্যুর গাইডরা জানান, কটকা, কচিখালী ও নীলকমলে একসময় প্রচুর হরিণ দেখা যেত। সেখানে মিলত বাঘের উপস্থিতিও। অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে বনের ওইসব এলাকায় আগের মতো দেখা যায় না হরিণ।

বনের প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটন নিয়ে কাজ করা খুবির ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ইচ্ছা হলেই অভয়ারণ্যে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করা দরকার। নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারলে পর্যটকের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে বেশির ভাগ সময় এটি নিয়ন্ত্রণে থাকে না।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবনে ২০ বছর মেয়াদি পর্যটন মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ চলছে। এর ফলে পর্যটকবাহী বিশেষায়িত নৌযান ছাড়া বনের মধ্যে অন্যরা প্রবেশ করতে পারবে না। পর্যটকের সংখ্যাও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। তখন অভয়ারণ্যের ওপর চাপ আরও কমবে।

 

খুলনা গেজেট/হিমালয়




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!