ফি বছর প্রতিশ্রুতি মিললেও কাজের কাজ হয়নি। পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বাধীন সৌধ ও কমপ্লেক্স। ফলে মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে হাজার হাজার মানুষের পদভার ও শ্রদ্ধায় জেগে উঠলেও সারা বছরই অবরক্ষিত থাকে খুলনার গল্লামারী স্বাধীনতা সৌধ। আর এরমধ্যে কেটে গেছে ১৫ বছর- ২০০৯-২০২৪।
খুলনার সাংস্কৃতিক সংগঠক ও নাগরিক নেতারা এ ঘটনাকে লজ্জাজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেছেন, গল্লামারী দেশের অন্যতম বৃহৎ বধ্যভূমি। যেখানের মাটিতে পরতে পরতে মুক্তিকামী মানুষের রক্ত ছড়িয়ে আছে। সেখানে একটি কমপ্লেক্স নির্মাণে সময় ক্ষেপন দু:খজনক।
মহানগরী খুলনার অন্যতম প্রবেশ পথ গল্লামারী। শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে দক্ষিণে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের পাশের এ স্থানটি ছিল একাত্তরের রক্তঝড়া দিনগুলোতে শহরের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয় এখানে। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর ‘খুলনা মুক্ত’ হওয়ার পর এখান থেকেই উদ্ধার হয় কয়েক শ’ মাথার খুলি। স্বাধীনতার পর খুলনার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে খুলনা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে গল্লামারী বধ্যভূমিতে ছোট একটা স্মৃতিসৌধ তৈরী করা হয়। ১৯৯০ সালে ২৬ মার্চ এটির উদ্বোধন করেন শহীদ পিতা আলতাব উদ্দিন আহম্মদ। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক ও পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেনের উদ্যোগে সেখানে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও ওই বছর ২৬ মার্চ বিজয় মঞ্চের উদ্বোধন হয়। আর ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহুল এখানে ১০-১১ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা জেলা পরিষদ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। দুই কোটি ব্যয়ে নিমার্ণ হয় মূল স্তম্ভও। এরপর কেটে গেছে ৮ বছর। দফায় দফায় এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে চিঠি চালাচালি করেও সুফল পায়নি জেলা পরিষদ। ফলে গল্লামারী স্বাধীনতা সৌধের মূল স্তম্ভ নির্মিত হলেও অর্থসংকটে বাকি কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে সীমানা প্রাচীর বা নিরাপত্ত ব্যবস্থা না থাকায় চত্বরে অবাঞ্ছিত/অনাকাঙ্খিত লোকজনের পদচারণা, অবাধে গরু-ছাগল ও কুকুরের বিচরণে প্রতিনিয়ত সৌধের পবিত্র নষ্ট হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমের পানি জমে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় জলমগ্ন হয়ে পড়ছে সৌধের আশপাশ।
খুলনা জেলা পরিষদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহুল গল্লামারীতে স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য জেলা পরিষদ ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ওই সময় সৌধটি নির্মাণে ১০-১১ কোটি ব্যয় ধরা হয়। প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী সৌধের মূল স্তম্ভ ছাড়াও, প্রকল্পে রয়েছে স্তম্ভের চারপাশে ১০ ফুট লাল টাইলস বসানো, পায়ে হাঁটার পথ, পার্কিং ইয়ার্ড, সীমানা প্রাচীর, গেইট, সিকিউরিটি শেড, রেস্টুরেন্ট, দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান, পানির ফোয়ারা ইত্যাদি। এর মধ্যে মূল স্তম্ভ নির্মানে ব্যয় ধরা হয় ২ কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটি অনুমোদনের পর মূল স্তম্ভ নির্মাণে ২ কোটি বরাদ্দ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। অর্থ বরাদ্দের পর দুই দফা দরপত্রের আহ্বান করে জেলা পরিষদ। দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ সালের ২৩ জুন আহ্বান করা দরপত্রে কাজটি পায় খুলনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আজাদ-ইলোরা জেভি। যার কার্যাদেশ হয় ২০০৯ সালের ১৫ নভেম্বর। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে মূল স্তম্ভ নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই বছর (২০১০) ১৮ অক্টোবর সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র ও জেলা প্রশাসকসহ খুলনার গণ্যমান্য বক্তিবর্গ নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করেন। ওই সময় মেয়র সৌধের মাস্টারপ্লান অনুযায়ী অন্যান্য কাজ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ করেন। এরপর ২০১১ সালের ১০ মার্চ স্মৃতিসৌধের স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন নির্মিত ওই মূল স্তম্ভ পরিদর্শন করেন। তিনিও স্মৃতিসৌধটিকে পূর্ণতা দিতে মূল নকশা বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন। তাঁর পরামর্শ ও মূল নকশা অনুযায়ী স্মৃতিসৌধের পূর্ণতা দিতে ২০১১ সালের মার্চে স্থানীয় সরকার বিভাগে বাকী ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ পেতে পত্র প্রেরণ করে জেলা পরিষদ। স্থানীয় সরকার বিভাগ বাকী অর্থ প্রদান না করে ওই বছরের এপ্রিল মাসে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে অর্থ প্রদানে সুপারিশ ও নির্দেশনা দেয়। এরপর ২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠির অনুলিপি দেয় জেলা পরিষদ। কিন্তু আজ অবধি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি।
খুলনার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি হুমায়ূন কবির ববি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘যেখানের মাটিতে রক্তের পরতে পরতে শহীদের রক্ত লেগে রয়েছে। সেখানে দীর্ঘদিনেও স্মৃতি সৌধের অপূর্ণতা ও অবরক্ষিত রাখা দু:খজনক। অনেক ক্ষেত্রে প্রতি অর্থবছরে কোটি কোটি টাকা অবচয় হলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার কাজ হয়নি। এতে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে। আমরা দ্রুত পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা সৌধ ও কমপ্লেক্স দেখতে চাই।’
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলদার বলেন, ‘খুলনার বিভিন্ন স্থানের বধ্যভূমির মতো গল্লামারীও অবহেলিত। এটি এখন খুলনার অন্যতম প্রবেশ পথ। তাই এটি সংরক্ষণ করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু বছরের পর বছর এমন অবস্থা লজ্জাজনক।’
গল্লামারী স্বাধীনতা সৌধের নকশা অনুযায়ী বাকী কাজ সম্পন্ন করতে অর্থ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয় বলে এর আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন খুলনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ। তিনি বলেছেন, স্মৃতিসৌধটির পূর্ণতা দিতে পারলে এটিই হবে দেশের দ্বিতীয়তম দৃষ্টিনন্দন স্বাধীনতা সৌধ।
খুলনা গেজেট/কেডি