অর্থ আত্মসাৎ ও নারী কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত খুলনা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বিতর্কিত অধ্যাপক মোঃ সুজাউদ্দোলাহকে বেসিক ট্রেনিং কোর্সের কোর্স পরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করায় স্টেক হোল্ডারদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। এছাড়া দেড়মাস পর বর্তমান অধ্যক্ষ অবসরে গেলে বিতর্কিত ওই শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার তালিকায় থাকায় অন্যান্য শিক্ষকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (লেইস) নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় দেশের সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক পর্যায়ের নবীন শিক্ষকদের বেসিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। ওই প্রতিষ্ঠানে গত ২৩ অক্টোবর থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ তৌফিক আহম্মদ ২১ অক্টোবর এক অফিস আদেশে বিতর্কিত ওই শিক্ষককে সি গ্রুপের কোর্স পরিচালক ও ট্রেইনার হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। এরপর থেকে কলেজের স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে অসন্তোষসহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, একই প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ৫৬ দিনের প্রশিক্ষণে অধ্যাপক সুজাউদ্দোলাহ সহ অপর দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়ম, নারী কেলেঙ্কারিসহ প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে পাবনা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের-উপাধ্যক্ষ এবং একইসাথে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে ওই প্রতিষ্ঠানের এক নারী শিক্ষার্থীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে। পরে ওই নারী শিক্ষার্থী পাবনা সদর থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে প্রেরণ করে। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে ওএসডি করে। পরবর্তীতে মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ, সরকারি কলেজ-২ শাখা থেকে তাকে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, খুলনায় বদলি করা হয়।
খুলনা টিটি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. শেখ রেজাউল করিম বলেন, ‘তিনি পাবনা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে উপাধ্যক্ষ থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে ওই কলেজের এক নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক সাসপেনশনে ছিলেন। পরবর্তীতে তার সাসপেনশন প্রত্যাহার হয়। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ায় কোন সরকারি টিচার ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ তাকে কলেজে যোগদান করাতে রাজি হননি। তিনি ভালো হয়ে যাবেন এ প্রত্যাশায় তাকে খুলনা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে যোগদান করাতে রাজি হই। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। অদ্যাবধি তার স্বভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি’। তিনি বলেন, ‘তার মতো অসৎ চরিত্রের ভয়ঙ্কর একজন লোক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেলে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে গতবছর মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের মাদ্রাসাসমূহের আল হাদিস পাঠদানকারী নির্বাচিত শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব পোষনের অভিযোগ ওঠে। প্রশিক্ষনার্থীরা গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর তাকে প্রশিক্ষক পদ থেকে অব্যহতি দেওয়ার জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বরাবর আবেদন করেন।
তৎকালীন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর রহিমা খাতুন বলেন, ‘অভিযোগ সত্য হলেও তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমি এলপিআরে আছি। ওসব নিয়ে আমাকে কোন ঝামেলায় জড়াবেন না প্লিজ’।
তার বিরুদ্ধে নিউ কারিকুলাম ডেসিমিনেশন স্কিম কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং সহকারী প্রধানগণের মনিটরিং ও মেন্টোরিং চতুর্থ ব্যাচের প্রশিক্ষক এবং প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে। ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. শেখ মোঃ রেজাউল করিম তাকে খুলনা ভেন্যু থেকে প্রত্যাহার করার জন্য প্রকল্পের স্কিম পরিচালক বরাবর অনুরোধ জানান।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রফেসর মোঃ সুজাউদ্দোলাহ খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘পাবনা টিটি কলেজে ষড়যন্ত্রমূলক একটি মিথ্যা মামলা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ সাসপেন্ড করেছিল। পরবর্তীতে আদালত থেকে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ আমাকে খুলনা টিটিসিতে বদলি করে। লেইস প্রকল্পের পূর্বেকার প্রশিক্ষণের কোন দায়িত্বে ছিলাম না, শুধু ট্রেনার হিসেবে ছিলাম। সুতরাং ট্রেনার হিসেবে অর্থ আত্মসাৎ কিংবা অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া প্রিন্সিপালের স্বাক্ষর ছাড়া কেউ কোন অর্থ উত্তোলন করতে পারেন না’।
তিনি বলেন, ‘এখানে যোগদানের পর বিগত চার বছরে যারা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন তারা কোন কর্মকাণ্ডের সাথে আমাকে সম্পৃক্ত করেননি। বিগত দিনে এ প্রতিষ্ঠানে অনেক অনিয়ম হয়েছে এ সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে একটা গ্রুপ ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে’।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ তৌফিক আহম্মদ বলেন, ‘তিনটি গ্রুপের প্রশিক্ষণ একই সাথে শুরু হওয়ায় প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী দুটি গ্রুপের পরিচালক অধ্যক্ষ থাকবেন। বাকী একটা গ্রুপের পরিচালক উপাধ্যক্ষ থাকবেন। উপাধ্যক্ষ না থাকলে সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র শিক্ষক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সুতরাং নিয়ম অনুযায়ী তাকে পরিচালক করা হয়েছে। প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি সঠিক নয়। প্রকল্পের অর্থ কমিটির মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীরা খরচ করে থাকে। আমরা শুধু মনিটরিং করি’।
এদিকে এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেকে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহের বিভাগীয় তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম

