শুক্রবার । ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫ । ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

লবণাক্ততা বাড়ায় কমছে আবাদি জমি

মামুন আহমেদ, বাগেরহাট

বাগেরহাটের জলাভূমিজুড়ে একসময় যে হাওয়ায় দুলত সোনালি ধানের শিষ, সেখানে এখন ঢেউ তুলে বাজে লবণাক্ত পানির শব্দ। ধানের মাঠ সংকুচিত হয়ে জায়গা দিচ্ছে চিংড়ির ঘেরে। গত এক দশকে উপকূলীয় এই জেলায় যে বদল এসেছে তা কারও জন্য এনে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি, আবার কারও জীবনে বয়ে এনেছে অস্থিরতা ও ক্ষতি।

রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ থেকে শুরু করে বাগেরহাট সদরের বিস্তীর্ণ চাষযোগ্য জমি রূপান্তরিত হয়েছে চিংড়ি চাষের পুকুরে। বড় লিজধারী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য এ পরিবর্তন বৈদেশিক বাজারে ‘সাদা সোনা’ রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়ালেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট কৃষক ও দিনমজুরেরা। বহু পরিবার জমি হারিয়ে, দেনার বোঝা বাড়িয়ে এবং চাষাবাদের অনুপযোগী মাটি নিয়ে দিশেহারা।

মোরেলগঞ্জের পুটিখালী গ্রামের কৃষক সিদ্দিকুর রহমান রহমান জানান, আগে তাঁর সব জমিতেই ধান হতো। এখন ২.৫ বিঘায় ধান চাষ করেন, বাকি ৫ বিঘা চলে গেছে বাগদা চিংড়ির ঘেরে।

একই উপজেলার তেলিগাতি গ্রামের কৃষক আলম শেখ জানান, তাঁর পুরো ৫ বিঘা জমিই এখন চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত হয়, ধান চাষ আর করেন না।

তিনি বলেন, “এই বাণিজ্যিক সাফল্যের পেছনে আছে ক্ষতির গল্প। আশপাশের ঘের থেকে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে হাজারো কৃষকের জমি নষ্ট হয়েছে। ধানের ফলন কমে যাওয়ায় অনেককে কম দামে জমি লিজ দিতে বাধ্য হতে হয়েছে।”

২০২৪ সালে খুলনার মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এবং বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ জরিপে দেখা যায়, জেলাটির বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা গত এক দশকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন চিংড়ি ঘের বিস্তৃতি এ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। পশুর, দড়াটানা, পনগুছি ঘষিয়াখালী নদীর লবণাক্ততা শুষ্ক মৌসুমে (মার্চ এপ্রিল) ১৫৩০ ডেসি-সিমেন্স/মিটার পর্যায়ে উঠে যায়, যা ধানসহ অধিকাংশ ফসলের সহনক্ষমতার বহুগুণ বেশি।

বাগেরহাট ২০২০ সালে জেলার মোট কৃষিজমি ছিল ১,৮৪,৮৪১ হেক্টর। ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১,৬০,৮৬১ হেক্টরে। যদিও ফসলচক্রের অনুপাত (৬১% একফসলি, ২৭% দুইফসলি, ১১% তিনফসলি) প্রায় অপরিবর্তিত, তবে ক্রপিং ইন্টেনসিটি বেড়ে ১৫১% থেকে হয়েছে ১৫৪% যা দেখায় একফসলি জমির আধিক্য এবং লবণাক্ততা বাড়লে এ জমিগুলো সহজেই ঘেরে পরিণত হচ্ছে।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাগেরহাটে বাগদা চিংড়ি চাষ হচ্ছে ৫২,৫৫১ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন ২০,৯৪০ মেট্রিক টন। গলদা চাষ হচ্ছে ১৯,৭৭৩.৩ হেক্টরে, উৎপাদন ১৯,৭১৬.৩ মেট্রিক টন। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরে চিংড়ি থেকে আয় প্রায় ৩,৭০০ কোটি টাকা। যা দেশের মোট চিংড়ি আয়ের (গত অর্থবছরে ৪ হাজার কোটি টাকা) প্রায় সমান।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোঃ মতাহার হোসেন বলেন, “শিল্পায়ন, শহরায়ণ এবং নদীর লবণাক্ততা বৃদ্ধিই চাষযোগ্য জমি কমে যাওয়ার মূল কারণ।” তাঁর ভাষায়, “নভেম্বর থেকেই লবণাক্ততা ঢুকতে শুরু করে, যা আগে জানুয়ারি মাসে হতো। মার্চ-এপ্রিল নাগাদ ফসল এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় লবণ-সহনশীল ফসলের প্রচলন ও একফসলি জমিকে দুই ফসলি ব্যবস্থায় আনতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ।”

তিনি আরও জানান, “অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে জমি ঘের বানাতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা সাময়িক লাভ দিলেও দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে।”

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন