ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বরাবাঁকিতে যোগী আদিত্যনাথের সরকার একটি প্রাচীন মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর ওই এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
প্রশাসন দাবি করছে, ওই মসজিদের কাঠামোটি অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছিল এবং এলাহাবাদ হাইকোর্টের অনুমতি নিয়েই তারা সেই স্থাপনাটি ভেঙেছে। তবে অল ইন্ডিয়া পার্সোনাল ল বোর্ড ও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এই মসজিদ ভাঙার তীব্র নিন্দা করে গোটা ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে।
বরাবাঁকির স্থানীয় মুসলিমরাও বলছেন, গত ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই মসজিদে লাগাতার নামাজ পড়া হয়ে আসছিল।
উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনৌ থেকে মাত্র বিশ মাইল দূরে পুরনো জনপদ ও জেলা শহর বরাবাঁকি। বরাবাঁকির রাম সনেহি ঘাট তহসিলে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবনের লাগোয়া চত্ত্বরেই ছিল গরিব নেওয়াজ মসজিদ – কিন্তু মাসদুয়েক আগে জেলা প্রশাসন সেখানে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার পর থেকে এলাকায় তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। এরপর মঙ্গলবার কর্তৃপক্ষ বিশাল বাহিনী নিয়ে এসে মসজিদের পুরো কাঠামোটিই ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।
বরাবাঁকির জেলা প্রশাসক আদর্শ সিং এরপর সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “ওই অবৈধ স্থাপনা কেন ভেঙে ফেলা হবে না তার কারণ দেখাতে আমরা সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নোটিশ দিয়েছিলাম গত ১৫ মার্চ। কিন্তু ওখানে বসবাসকারীরা শুনানিতে না-এসে সেখান থেকে পাট গুটিয়ে চলে যান। এরপর ২রা এপ্রিল এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনৌ বেঞ্চের রায়েই প্রমাণিত হয়ে যায় যে ওই কাঠামো অবৈধ।”
আদালতের আদেশেই কাঠামোটি ভাঙা হয়েছে বলে প্রশাসন দাবি করলেও গরিব নেওয়াজ মসজিদের খাদেম রমজান আলি বলছেন, তাদের বক্তব্য পেশ করার কোনও সুযোগই দেওয়া হয়নি।
তিনি জানাচ্ছেন, “গত ১৭ই মার্চ আমরা নোটিশের জবাব দিতে গেলেও কাছারি তা গ্রহণ করেনি। এরপর ওরা জেসিবি এনে আমাদের মসজিদের গেট ভেঙে ওখানে রাতারাতি দেওয়াল তুলে দেয়।”
আইনজীবী জাফরিয়াব জিলানির মতে, এই মসজিদ ভেঙে আদালতের রায়ের অবমাননা করা হয়েছে। “তারপর থেকেই বলা শুরু হয়, এটা নাকি কোনও মসজিদই নয়! অথচ আমাদের পূর্বপুরুষরা সেই কবে ব্রিটিশ আমল থেকে এই মসজিদ চালাচ্ছেন, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডেও এটি নথিভুক্ত। অথচ সেই মসজিদের চারপাশে ব্যারিকেডে ঘিরে, পুলিশ মোতায়েন করে আমাদের সেখানে ঘেঁষতেও দেওয়া হচ্ছিল না।”
গতকাল মসজিদটি ভেঙে ফেলার পর অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ওই মসজিদটি নিয়ে কখনো কোনও বিতর্ক ছিল না এবং সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সেটি ধূলিসাৎ করা হয়েছে।
সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মৌলানা খালিদ সাইফুল্লা রেহমানি আরও বলেছেন, ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুসলিমরা সেখানে নামাজ পড়ে আসছেন – যে বক্তব্য নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যেও কোন দ্বিমত নেই।
বরাবাঁকির প্রবীণ শের আলি আজন্ম এই গরিব নেওয়াজ মসজিদেই নামাজ পড়েছেন – কিন্তু গত দুমাস ধরে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তার হিন্দু প্রতিবেশী বেণী শর্মাও জানাচ্ছেন, “সেই ছোটবেলা থেকে এখানে কখনো নামাজ পড়া বন্ধ হয়েছে বলে দেখিনি।”
উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকার গত চার বছর ধরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটা ‘দৈনন্দিন সাম্প্রদায়িকতার’ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে – এমন অভিযোগ বারে বারেই উঠেছে। বরাবাঁকির এই ঘটনাও তারই সবশেষ দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন লখনৌতে সাংবাদিক মুনমুন রেহমান।
তিনি বলছিলেন, “যোগীর আমলে যেভাবে মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে তা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন উঠছে এবং এখন তারা মুসলিমদের মসজিদ ভাঙতেও এতটুকু দ্বিধা করছে না। বরাবাঁকির ঘটনায় টুইটারে অনেকেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছেন এবং আমরা খবর পাচ্ছি ওই এলাকার মুসলিমদের মধ্যে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।”
পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টায় বরাবাঁকির ওই এলাকায় বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে। ওদিকে মসজিদ ভাঙার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডও আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সূত্র : বিবিসি।
খুলনা গেজেট/এমএইচবি