সোমবার । ১৭ই নভেম্বর, ২০২৫ । ২রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
বাস দুর্ঘটনায় পঙ্গু হাবিবুর এখন ইজিবাইক চালক

‘চাকা ঘুরলে টাকা, না ঘুরলে নেই’

মোহাম্মদ মিলন

“কাজ না করলে তো পেট চলে না। গাড়ি চালালে টাকা, না হলে নেই। সবসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়কে চলতে হয়। যে-কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এমনই একটি দুর্ঘটনায় পড়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছি, হারিয়েছি একটি পা। তিন বছর বিছানায় ছিলাম। ওই সময়গুলো যে কী কষ্টে দিন পার করেছি তা বলার মতো নয়। পরিবারে তিন মেয়ে ও স্ত্রী। একসঙ্গে চিকিৎসা আর সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সংসার চলতো ধার-দেনা, মেয়ের টিউশনি করার টাকা আর পরের বাড়িতে স্ত্রী’র কাজ করা অর্থ দিয়ে। একটি পা থাকলেও সেটি আর চলে না। চলাচল করতে পারি না। তবুও পেটের দায়ে এখন অনেক কষ্টে একবেলা ইজিবাইক চালাতে হয়।” এই প্রতিবেদককে এভাবেই বলছিলেন খুলনা-সাতক্ষীরা রুটে দুর্ঘটনায় পা হারানো বাসচালক মোঃ হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেন, “মটর শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে দুর্ঘটনায় সামান্য কিছু সহযোগিতা পেয়েছি, কিন্তু তা তেমন কিছুই না। এখনও সরকারি কোনো সহযোগিতা জোটেনি। এমন অনেক চালক এভাবে পঙ্গু অবস্থায় পড়ে আছে। নেই ভবিষ্যৎ জীবনের নিশ্চয়তা, আছে আর্থিক অনটন।”

বাসচালক মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, “১৯৯৬ সালে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করি। ২০০৬ সাল থেকে খুলনা-সাতক্ষীরা রোডে বাস চালানো শুরু করি।”

দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর খুলনা থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে ট্রিপ (যাত্রী) নিয়ে যাচ্ছিলাম। সাতক্ষীরার মির্জাপুর স্টপেজ থেকে যাওয়ার পথে একটি ট্রাক আসছিল। আর ট্রাকের সামনে ছিল ইজিবাইক। ট্রাকটি বার বার হর্ন দিলেও সাইড দেয়নি। আমিও ক্রস করার সময় ট্রাকটি ব্রেক করে। এসময় ট্রাকের পেছনের সাইডের ডালাটি আড় হয়ে যায়। বাসটি ট্রাকের ডালায় ধাক্কা লাগে। এসময় গাড়ি সাইডে পড়ে গাড়ির সামনে আমার পা আটকে যায়। স্থানীয় জনগণ আমাকে উদ্ধার করে। তখন আমার পা ঝুলছিল। পায়ে হাড় ছিল না, সামান্য মাংস-চামড়া লাগানো ছিল। আমাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সেখান থেকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক ও সকলের পরামর্শে বা পা কেটে ফেলা হয়। আর ডান পায়ের মাঝের দিকে একটি হাড় ভেঙে যায়। এজন্য আমি হাঁটা চলা করতে পারি না। তিন বছর আমি বিছানায় ছিলাম। তিন বছর পরে ডান পায়ে কিছুটা শক্তি পেয়েছি।”

নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে হাবিবুর বলেন, “আমার পরিবারে তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়েটি নিয়ে থাকি। সে প্রাইভেট পড়ায় আর স্ত্রী মানুষের বাড়িতে কাজ করে। আর আমি একবেলা অটোরিকশা চালাই। চলাফেরা তো করতে পারি না, সেই সঙ্গে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। রাস্তায় ঝুঁকি আছে জেনেও বাধ্য হয়ে পেট চালানোর জন্য, পরিবারের জন্য অটো চালাতে হচ্ছে। বেশি দিন অসুস্থ থাকলে বিপাকে পড়ে যায়। অন্য কিছু যে করবো সেই সামর্থ্য নেই, পয়সা নেই। এখন যদি সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছু সহযোগিতা পাওয়া যেত তাহলে ছোট একটি দোকান করে ব্যাবসা পরিচালনা করতে পারতাম। মেয়ের লেখাপড়া এবং সংসারটা ভালোভাবে চালাতে পারতাম।”

বাসচালক হাবিবুরের স্ত্রী নূর আরবী বেগম বলেন, “ওর আব্বার অ্যাক্সিডেন্ট হলে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে হলো। তখন আমাদের সংসারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। ঠিকমতো ডাল-ভাত খেতেও পারতাম না। সেই সময়ে বাধ্য হয়ে লোকের বাসায় কাজ করতে শুরু করি। চিকিৎসার পর তিনি যখন শয্যাশায়ী হলেন, তখন আমার দুই মেয়ে টিউশনি করে যা সামান্য টাকা আনতো, তা দিয়ে সংসার চলতো না। ঘর-ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল সব মিলে কোনোভাবেই চলা সম্ভব ছিল না। ওর আব্বা এখন আবার গাড়ি চালাতে যায়। রিকশাওয়ালারা এসে ধরে নিয়ে যায়, আবার দিয়ে যায়। একবেলা কাজ করলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, ব্যথায় নড়াচড়া করতে পারে না। এভাবেই চলছে আমাদের দিনকাল।”

শুধু হাবিবুরই নয়, এমন দশা অধিকাংশ মটর শ্রমিকদের। বাস চালক মাহফুজুর রহমান বলেন, “ভোর ৫-৬টার দিকে চালকের আসনে বসি। রাত ৯টা-১০টার পর নামি। কিন্তু এখানে যে আয় হয় তা দিয়ে পরিবার নিয়ে চলতে অনেক কষ্ট হয়। শেষ বয়সে এসে আমাদের আর কিছু থাকে না, শুধু আমরাই। প্রতিদিনের আয়, প্রতিদিনই চলে যায়। আমাদের কোনো সঞ্চয় থাকে না। হরতাল অবরোধে গাড়ি বন্ধ থাকলে আমাদেরও বসে থাকতে হয়। শিখেছি বাস চালানোই, বিকল্প কিছু পারি না। শেষ বয়সে কোনো নিশ্চয়তা আমাদের নেই। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কোনো জায়গা নেই।”

খুলনা-পাইকগাছা রুটের বাসচালক বাবলুর রহমান বলেন, “এক পা কবরে, এক পা জেলে এই দুশ্চিন্তা নিয়ে নামতে হয়। গাড়ির চাকা ঘুরলে টাকা পাই, না ঘুরলে নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার।”

বাসের কন্ট্রাক্টর মোঃ ফারুখ বলেন, “মোটর শ্রমিকরা খুব দুর্দশায় রয়েছে। অনেক দিন বাড়ি থেকে নিজ খরচে এসে ট্রিপ না পেয়ে গাটির (নিজ) খরচে চলে যেতে হয়। মালিকরা কিছু দেয় না। সংসার খুব কষ্টে চলে, ধার দেনা করে নিয়ে চলতে হয়।”

খুলনা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, “খুলনা মটর শ্রমিক ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক। মটর শ্রমিকদের খুব দুরবস্থার মধ্যে দিন পার করতে হয়। লেখাপড়া করানো, ছেলে- মেয়েদের ভালো একটা চাকরি দেব, আমি অবসরে গেলে বা পঙ্গুত্ববরণ করলে সেই ছেলে আমার দায়-দায়িত্ব নেবে, সেই অবস্থাও আমাদের নেই। যদিও কোনো ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করে, পরে আর্থিক অনটনে পড়ে ছেড়ে দিতে হয়। যেহেতু আমি ড্রাইভার, আমার ছেলেও হয় ড্রাইভার, না হয় সুপারভাইজার। ঘরের স্ত্রী পরের বাসায় কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আমরা সামান্য কিছু চিকিৎসার খরচ দেই, কিন্তু সেটি পূরণ হয় না। আমাদের পরিবহন সেক্টরের দিকে ভালো নজর কেউ দেয় না। এমনকি বছরে দুটি ঈদ উৎসবে বোনাসও নেই।”

তিনি বলেন, “শ্রমিকদের চাকরিতে কোনো নিশ্চয়তা নেই। শ্রমিকদের নিয়োগ পত্রের ব্যবস্থা হলে ভালো হতো। অন্তত চাকরিটা কি কারণে গেল তা যেন জানতে পারি। গাড়ির কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মালিকরা সাধারণত জামিন করাতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে আলোচনা ও চাপের মাধ্যমে গাড়ির টানের ড্রাইভারের জামিন করায়। ওই জামিন করানো পর্যন্তই শেষ। শ্রমিকদের এত দুর্দশা দেখার কেউ নেই।”

খুলনার ডেপুটি সিভিল সার্জন মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, “পরিবহনের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার বা শ্রমিকরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। ফুসফুসের অনেক রোগে ভুগতে পারে। যেমন যক্ষ্মা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমা রোগেও ভোগে। কিডনির নানা জটিলতায় ভোগে। শব্দের কারণে মাথা যন্ত্রণা, কানের শ্রবণ শক্তি কমে যায়। দীর্ঘসময় বসে থাকায় পা ফোলা, পায়ে রস আসে, শিরাগুলো ফুলে যায়। অতিরিক্ত কাজের চাপে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। নিদ্রাহীনতায় ভোগে। এই কারণে হৃদ্রোগে আক্রান্তও হয়।”

হাইওয়ে পুলিশের খুলনা রিজিয়ন সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন দায়ী। এছাড়া অনেক চালকের লাইসেন্স নেই, পেশাদার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। অনেক বেশি সময় ধরে গাড়ি চালায়। ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর কথা থাকলেও ডাবল ট্রিপ মারে। ঘণ্টা ৮০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর কথা থাকলেও অনেক সময় ১০০-১১০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালায়। মহাসড়কে অনুমোদনহীন যানবাহন থাকে, ধীরগতির যানবাহন ও থ্রি হুইলার থাকে। এগুলো সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।”

খুলনা বিআরটিএ’র পরিচালক জিয়াউর রহমান বলেন, “বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে আমরা ড্রাইভারদের সচেতনতা বৃদ্ধি, যেন সঠিকভাবে গাড়ি চালায় এবং পাঁচ বছর পর পর যখন ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করে আবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যাতে তারা আইন সম্পর্কে সঠিকভাবে জানে এবং গাড়ি সঠিকভাবে চালাতে পারে। এছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি যাতে রাস্তায় চলাচল করতে না পারে সেজন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই দুর্ঘটনা যাতে রোধ করা যায়। মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা।”

বিআরটিএ’র পরিচালক আরও বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে তার পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। আহত হওয়ার ধরনের ভিত্তিতে ১ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। যাতে ভুক্তভোগী পরিবার একটু হলেও স্বাবলম্বী হয়।”

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন