সোমবার । ১৭ই নভেম্বর, ২০২৫ । ২রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

জাতিসংঘের তদন্তে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুরুতর চারটি অভিযোগ

গেজেট প্রতিবেদন

গেল বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার নির্দেশ দেন। এটি তাৎক্ষণিক প্রাণঘাতী বা গুরুতর আঘাতের হুমকি সৃষ্টি করতে থাকে। তিনি হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার গ্যাস ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করারও নির্দেশ দেন। হেলিকপ্টারে বিশেষ বাহিনীকে টিআর গ্যাস, লান্সার ও শর্ট গানের মতো অস্ত্রও দেখা যায়। বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করার নির্দেশদাতা, চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পোড়ানোর অভিযোগও আনা হয়।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।

হেলিকপ্টার থেকে গুলির অভিযোগ : আসামি শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ দেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন আসামি শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে। যা তাদের জ্ঞাতসারে কার্যকর করা হয়েছে।

মানবাধিকার দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানো এবং সম্ভবত অবৈধ শক্তি প্রয়োগের উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টারের ব্যবহার র‌্যাব, পুলিশ ও প্রতিবেদন অনুযায়ী সেনাবাহিনীর অ্যাভিয়েশন ইউনিটও এই বিক্ষোভগুলোর ক্ষেত্রে হেলিকপ্টার মোতায়েন করে। বিশেষ করে র‌্যাবের কালো হেলিকপ্টার গুলো বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানো এবং তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের জন্য ব্যবহার করা হয়।

ওএইচসি এইচআরকে দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য অনুযায়ী র‌্যাব বা পুলিশের হেলিকপ্টার থেকে বারবার টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। ঢাকার মিরপুর (১৮ জুলাই), মহাখালী (১৮ জুলাই), ধানমন্ডি (১৮ ও ১৯ জুলাই), বাড্ডা (১৯ জুলাই), মোহাম্মদপুর (১৯ জুলাই), রামপুরা (১৯ জুলাই), শাহবাগ (১৯ জুলাই), বসুন্ধরা (১৯ জুলাই, ২ ও ৩ আগস্ট), (২০ জুলাই), যাত্রাবাড়ী (২০ ও ২১ জুলাই)। এ ছাড়া রামপুরায় (১৮ জুলাই) সাউন্ড গ্রেনেডও নিক্ষেপ করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও সাক্ষ্য দিয়েছেন, ১৯-২১ জুলাইয়ের মধ্যে তারা হেলিকপ্টারে থাকা বাহিনীকে রাইফেল বা শটগান থেকে প্রাণঘাতী গুলি ছুড়তে দেখেছেন। এই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বাড্ডা, বসুন্ধরা, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মহাখালী, মোহাম্মদপুর ও রামপুরায়।

একজন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এটিও স্বীকার করেছেন যে, এই ধরনের অস্ত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়, এমনকি যদি তারা তৎক্ষণাৎ প্রাণঘাতী বা গুরুতর আঘাতের হুমকি সৃষ্টি করেও থাকে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও র‌্যাবের মহাপরিচালক স্বীকার করেছেন, র‌্যাবের হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ফেলা হয়। তবে তারা নিশ্চিত করতে পারেননি যে, র‌্যাবের হেলিকপ্টার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে গুলি ছোড়া হয়েছিল কি না। র‌্যাব ওএইচসি এইচআরকে জানিয়েছে, ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত তারা হেলিকপ্টার থেকে ৭৩৮টি টিয়ার গ্যাস শেল, ১৯০টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৫৫৭টি স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে তারা দাবি করেছে, এই সময়ের মধ্যে হেলিকপ্টার থেকে একবারও রাইফেল বা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়া হয়নি। ওএইচসি এইচআর বিভিন্ন ভিডিও সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে, যেখানে র‌্যাব ও পুলিশের হেলিকপ্টারে থাকা বাহিনীকে টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ব্যবহার করতে এই লঞ্চারগুলো দূর থেকে ফেলা বা শটগানের মতো দেখা গেছে। তবে লাঞ্চার চালু হলে টিয়ার গ্যাস পেলেড থেকে একটি স্বতন্ত্র সাদা ধোঁয়ার রেখা তৈরি হয়। ওএইচসি এইচআর এখন পর্যন্ত কোনো ভিডিও পায়নি, যেখানে স্পষ্টভাবে হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল বা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়ার প্রমাণ রয়েছে।

আবু সাঈদ হত্যার অভিযোগ : রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং ভিডিও ফুটেজের ভিত্তিতে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের পুলিশের সরাসরি জড়িত থাকার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। ওএইচসি এইচআর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে পাওয়া আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন ভিডিও ও ছবি পরীক্ষা করেছে। এসব ছবি ও ভিডিও মানোন্নয়নের কাজ করেছে ওএইচসি এইচআরের ডিজিটাল ফরেনসিক। এরপর তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে ছবি ও ভিডিও মিলিয়ে দেখে এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পুনঃনির্মাণের চেষ্টা করে। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন ২৩ বছর বয়সী আবু সাঈদ। পরিবারের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া।

ওএইচসি এইচআরকে দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিক্ষোভকারীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে জোর করে ঢোকার চেষ্টা করেন, তখন ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রসংগঠন) সমর্থকদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ ‘শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে গ্যাসের শেল এবং ফাঁকা গুলি ছুড়তে শুরু করে। পুলিশ বিশেষভাবে আবু সাঈদের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করে জানিয়েছে, তিনি গুরুতর আহত হন এবং পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘মাথায় আঘাত ও গুলির চিহ্নের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

ওএইচসিএইচআর বলেছে, নির্ভরযোগ্য একাধিক ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও ভিডিও চিত্রের ভিত্তিতে আবু সাঈদ হত্যাকা-ে পুলিশের সরাসরি জড়িত ও দায়ী থাকার বিষয়টি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য এবং এর পক্ষে যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।

যথাযথ ময়নাতদন্ত না হওয়া সত্ত্বেও নথিভুক্ত ক্ষত ও সংশ্লিষ্ট ভিডিও ফুটেজ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে যে কমপক্ষে দুবার গুলির ফলে প্রাণঘাতী মেটাল প্যালেটের আঘাতে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্লেষণ করা তথ্যের ভিত্তিতে এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে, আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে পুলিশ বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়েছে। আবু সাঈদ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।

চাঁনখারপুল এলাকায় ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ৬ জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

আশুলিয়ায় ৬ ছাত্র-জনতাকে আগুনে পোড়ানোর অভিযোগ : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরীহ নিরস্ত্র ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে ৫ জনের মরদেহ এবং ১ জনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন