প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক পর্যটন শিল্প, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নের পথ সুগম হবে

গাবুরার বেড়িবাঁধে উপকূলবাসীর মাঝে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নদী ভাঙ্গনের মত নানা সমস্যায় ভুগছে উপকূলীয় জনপদ সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ। নদী বেষ্টিত এই দ্বীপ ইউনিয়নের মানুষকে পুনর্বাসন করতে সরকার হাতে নিয়েছে প্রায় ১০২০.১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বহুল প্রতীক্ষিত টেকসই বাঁধ নির্মাণ মেঘা প্রকল্প। প্রকল্পটি এই এলাকার মানুষদের জন্য এক নতুন আশার আলো হয়ে এসেছে। বাঁধ নির্মাণ শুধু দুর্যোগ প্রতিরোধই করবে না, এই প্রকল্প দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক, পর্যটন শিল্প, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নের পথ সুগম করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মেঘা প্রকল্পের আওতায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে উপকূলীয় মানুষের যেমন বাসস্থান, মৎস্যঘের রক্ষা পাবে তেমনি পর্যটন শিল্পের দুয়ার খুলছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হলে সড়ক পথে সুন্দরবনে পর্যটক এর সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া এই অঞ্চলে গড়ে উঠবে রিসোর্ট, রেস্তোরাসহ পর্যটন নির্ভর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এতে করে উপকূলের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির হবে।

জানা যায়, ২০০৯ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের মানুষের জীবনে এক বিভীষিকাময় অধ্যায় নেমে আসে। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ইউনিয়নের পাউবো’র বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। প্রাণ হারায় বহু মানুষ। গৃহহীন হয় পড়ে সহস্রাধিক পরিবার। গাবুরার জনপদ পরিণত হয় এক বিশাল লোনা পানির জলাভূমিতে। এরপর একে একে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, রোয়ানু, আম্পান, ইয়াস ও সিত্রাং প্রতিটি দুর্যোগের সময়ই বেড়িবাঁধ ভেঙে গাবুরা ইউনিয়ন বারবার প্লাবিত হয়েছে।

বছরের পর বছর দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা এই উপকূলীয় মানুষ আজ নতুন করে আশা ও নিরাপত্তার আলো দেখতে পাচ্ছেন। পাউবো কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন টেকসই বাঁধ নির্মাণের মেঘা প্রকল্প ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পেরেছে। ২০২৪ সালে ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানলেও গাবুরা ইউনিয়নের কোথাও বেড়িবাঁধ ভাঙেনি। এলাকার মানুষজন ছিল নিরাপদে, অক্ষত ছিল বাড়িঘর। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে প্রথমবারের মতো গাবুরার বাসিন্দারা বুঝতে পেরেছেন একটি দৃঢ় ও পরিকল্পিত বাঁধ তাদের জীবন কতটা পরিবর্তন করতে পারে।

গাবুরা ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরেই নদীভাঙন ও প্লাবনের শিকার। টেকসই বাঁধ নির্মাণের ফলে উপকূলীয় ভাঙনের ঝুঁকি কমে এসেছে এবং মানুষজন আর ঘরবাড়ি হারানোর আতঙ্কে থাকবে না। বাঁধটি মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ীভাবে নির্মিত হচ্ছে যাতে এটি আগামী কয়েক দশক ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে সক্ষম।

নদীভাঙনের ঝুঁকি কমার পাশাপাশি এলাকায় জমির চাহিদা ও মূল্য বাড়তে শুরু করেছে। টেকসই বাঁধের কারণে নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত হলে স্থানীয় বাসিন্দারা আরও স্থায়ী ঘরবাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এতে স্থানীয় নির্মাণ খাতেও গতি আসবে এবং নতুন ব্যবসা ও পেশার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

স্থানীয় বাসিন্দা কাদের গাজী বলেন, “আইলার সময় আমি সব হারিয়েছি। তখন মনে হতো আমরা শুধু মরার জন্য বাঁচি। কিন্তু এখন ঝড়ের সময় বাড়িতেই থাকি। কোনো ভয় লাগেনা। এখন মনে হয় সত্যিই কিছু একটা বদলেছে।”

স্থানীয় নারী প্রতিনিধি রাশিদা খাতুন বলেন, “আগে পানির জন্য ২ কিলোমিটার হাঁটতাম। এখন টেকসই বাঁধ হওয়ায় গ্রামেই সুপেয় পানি পাচ্ছি। এটি আমাদের জীবনের বড় পরিবর্তন। বাঁধের নিরাপত্তা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গাবুরা ইউনিয়নের পাশেই থাকা সুন্দরবন হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে স্থানীয় হোটেল, রিসোর্ট, খাবার দোকান ও নৌবিহার কেন্দ্রিক ছোট ব্যবসার উন্মেষ ঘটছে, যা তরুণদের কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখতে পারবে।”

গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাছুদুল আলম জানান, এই মেঘা প্রকল্পটি গাবুরার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ায় গাবুরাবাসীর মনে স্বস্তি ফিরেছে। এই ইউনিয়নের মানুষ এখন খুবই নিরাপদবোধ করছে। প্রল্পটি এই এলাকার মানুষদের জন্য এক নতুন আশার আলো হয়ে এসেছে।

গাবুরা টেকসই বেড়িবাঁধ প্রকল্পের তত্তা¡বধানকারি সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডে বিভাগ-১এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সালাউদ্দিন জানান, এই প্রকল্পে ২৮ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ, ৮ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ, ৫টি নতুন স্লুইচ গেট, ১১টি ইনলেট এবং ৮টি খাল পুনঃখননের কাজ শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে কাজের অগ্রগতি প্রায় ১০০ শতাংশ। বর্তমানে বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণের মত টুকটাক কাজ চলছে। ইতিমধ্যে এই এলাকার মানুষ এই প্রকল্পের সুফল পেতে শুরু করেছেন।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন