খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১০৩৪
  যাত্রাবাড়িতে ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাচালকদের সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষে দুই পুলিশ আহত
  জুলাই গণহত্যা : ৮ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক মাসে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ

সাতক্ষীরা সীমান্তের ইছামতি নদীর ভাঙনে কমছে বাংলাদেশের ভূখন্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরা সীমান্তের ইছামতি নদীর অব্যহত ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে দেবহাটা উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম। নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে পাউবো’র বেড়িবাঁধে ভেঙে নদী গর্ভে বিলিন হচ্ছে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। ফলে ইছামতি নদীর ভাঙনে ক্রমশঃ কমছে বাংলাদেশের ভূখন্ড। আতংকিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় বসবাসকারিরা। নিঃস্ব হচ্ছে নদী তীরবর্তী মানুষেরা। জরুরী ভিত্তিতে নদী ভাঙনরোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশাংকা করেছেন এলাকাবাসী।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হাড়দ্দহা থেকে কালিগঞ্জের বসন্তপুর ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মুহাকমার পানিতর এলাকা থেকে হিঙ্গলগঞ্জ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভাজন করেছে ইছামতি নদী। কিন্তু সীমান্ত বিভাজনকারি ইছামতি নদীর অব্যহত ভাঙনে ক্রমশঃ ছোট হচ্ছে বাংলাদেশের মানচিত্র। ভাঙনের কবলে পড়ে নদী গর্ভে বিলিন হচ্ছে দেবহাটার বেশ কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি। এসব গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে দেবহাটা উপজেলার দেবহাটা, খানজিয়া, রাজনগর, ভাতসালা ও কোমরপুর। এরইমধ্যে এসব গ্রাম থেকে কয়েকশ’ বিঘা জমি ইছামতির ভাঙনে নদী গর্ভে চলে গেছে। সবচেয়ে বেশী গেছে রাজনগর মৌজার জমি।

পক্ষান্তরে ভরাট হচ্ছে ভারতের ওপারের ভূখন্ড। ইছামতি নদীর বেড়িবাঁধের উপর দাড়িয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় দুই তীরের পার্থক্য। ভারতের পরিকল্পিত নদী শাষণে বাংলাদেশ অংশে ভাঙন চলছে প্রতিনিয়ত। এতে বাড়িঘর ও ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে নদী তীরবর্তী মানুষেরা। আর নদীটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় মানুষ শুধু যে ভিটে-মাটিই হারাচ্ছে তা নয়, জমি হারাচ্ছে দেশ, আর এই ভাঙনের ফলে কমছে বাংলাদেশের ভূখন্ড। ফলে দেবহাটার মিনি সুন্দরবনের বিপরিত অংশে এবং ভাতশালা এলাকায় নদীসহ ভারতের মধ্যে গড়ে ওঠা বনায়নের কিছু অংশও বাংলাদেশের ভুখন্ড বলে দাবী করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

দেবহাটার টাউনশ্রীপুর গ্রামের ফারুক মাহবুবুর রহমান জানান, তিনিসহ এলাকার লোকজন নদীর মধ্যে চলে যাওয়া জমিতে একসময় ফুটবল খেলেছেন। অনেক স্থাপনা দেখেছেন, এখন সেখানে কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। তিনি বলেন, ইছামতি নদীর দেবহাটা এলাকার বিপরীতে ভারতীয় অংশে স্পষ্ট যে, নদী ভেঙে বাংলাদেশ যতটা ভূখন্ড হারাচ্ছে ভারত অংশে ততটাই বাড়ছে জমি। নদী ভাঙনরোধে ভারত ইছামতি নদীর পাড় জুড়ে গড়ে তুলেছে সারি সারি ইটের ভাটা। পাশাপাশি বিভিন্ন অংশে ঢালাই করে এবং গাছ লাগিয়ে তারা তাদের বাঁধ রক্ষা করছে। ভারতের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মুহাকমার টাকি এলাকায় ইছামতি নদীর পাড় ঘেষে গড়ে তুলেছে শত হোটেল মোটেল। সেখানে রীতিমত গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসছে ইছামতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। অথচ সম্পূর্ন উল্টো চিত্র বাংলাদেশ অংশে। এখানে প্রতিনিয়ত নদী ভেঙে শত শত বিঘা জমি চলে যাচ্ছে ইছামতির গর্ভে। দেবহাটার ২৪টি মৌজার মধ্যে ১১নং জে.এল রাজনগর মৌজাটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি রেকর্ডরুমে। তার বাকী অংশ এখন পাশের শিবনগর মৌজার ১২ নং জে.এল এর সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের বিদ্যমান মানচিত্র আকার পরিবর্তনের আশাংকা করা হচ্ছে।

দেবহাটার ভাতশালা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, বেশ কয়েকবছর ধরে ইছামতি নদী ভাঙনের ফলে এরইমধ্যে নদী গর্ভে হারিয়ে গেছে তার নিজের বাড়িসহ গ্রামের বহু বাড়িঘর, খেলার মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাদের পৈত্রিক কবরস্থানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কিন্তুু সীমান্তের ইছামতি নদীর ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিরা কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অব্যহত নদী ভাঙনের ফলে তার বর্তমান বাড়িটিও হুমকীর মূখে পড়েছে।

একই এলাকার গোলাম সরোয়ার জানান, বর্তমানে ভাতশালা এলাকায় ইছামতি নদীর যে অংশটি বিদ্যমান আছে তার পুরোটাই আমাদের অংশে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন অনুযায়ি নদী যেখান দিয়ে প্রবাহিত হোক না কেন তার মাঝ বরাবর থেকে সীমানা নির্ধারিত হয়ে থাকে। যে কারণে আমাদের জমিতে নদী থাকার পরও আমাদের জেলেরা নদীর মধ্যবর্তী অতিক্রম করতে পারেন না। তাছাড়া নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়া ভূখন্ডও আমাদের বলে দাবী করার সুযোগ থাকছে না। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবী জানান তিনি।

এ বিষয়ে দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইয়ানুর রহমান বলেন, ভাঙন এলাকার নদীর পাড় স্থাপন করার জন্য তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলেছেন। আমাদের অনেক জমি নদী গর্ভে চলে গেছে বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনকানুন রীতিনীতি মেনে সার্বিক চিত্র তুলে ধরে বিষয়টি জেলা প্রশাসনসহ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে কী পরিমান জমি আমরা হারিয়েছি তার কোনো হিসেব উপজেলা প্রশাসনের কাছে নেই বলে জানান তিনি। রাজনগর মৌজাটা এখন নেই এটিও স্বীকার করেন তিনি।

দেবহাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মুজিবর রহমান বলেন, খানজিয়া থেকে কোমরপুর পর্যন্ত সবখানেই কমবেশী নদী ভেঙেছে। দেবহাটার রাজনগর মৌজাটা আর নেই। বর্তমান নদী যেখানে আছে তার তিনভাগের দুইভাগ বাংলাদেশের। এখনই উদ্যোগ না নিলে আগামীতে দেবহাটা ম্যানগ্রোভ, দেবহাটা থানা, স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পও নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়ার আশাংকা করেন তিনি। দেশের মানচিত্রে দেবহাটা উপজেলার সীমানা যাতে বজায় থাকে সে বিষয়ে সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্বে) মোঃ সালাহউদ্দীন জানান, নদী ভাঙনের ফলে দেবহাটা উপজেলার সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকার ছয়টি পয়েন্ট নদী ভাঙন হয়েছে। নদীটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে নদী ভাঙনের ফলে অনেক এলাকায় আমরা জমি হারিয়েছি। বর্তমানে ভাঙনের তীব্রতা আরো বেড়েছে। স্থায়ীবাঁধ ছাড়া এর সমাধান করা সম্ভব নয়। ডেল্টা প্রকল্পের আওতায় নদীতে স্থায়ীবাধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হবে। তবে নদী ভেঙে হারিয়ে যাওয়া জমি ফেরত আনার বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আ.ন.ম গাউছার রেজা বলেন, দু’দেশের সীমানা নির্ধারনকারি নদীর স্রোত যে অবস্থায় থাকুক না কেন তার মাঝ বরাবর সীমান্ত নির্ধারিত হয়ে থাকে। শুধু তাই নয় সীমান্তে কোনো কাজ করতে গেলেও দেড়শ গজ বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয়। কাজে বাধা আসে। অথচ ভারত অনেক আগে থেকেই তাদের দেশের পাড়ের উন্নয়ন করে রেখেছে।

তিনি আরো বলেন, আইনের মাধ্যমে আমরা সমুদ্র জয় করেছি। সীটমহল সমস্যার সমাধান করেছি। অথচ এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হওয়ার স্বত্বেও এবিষয়ে রাষ্ট্রিয় উদ্যোগ কখনও চোখে পড়েনি। ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। ভারতের তুলনায় এর ভূখন্ড অনেক কম। এরপরও যদি প্রতি বছর নদী ভাঙনের কবলে পড়ে আমরা এভাবে জমি হারাতে থাকি তাহলে বাংলাদেশ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্র এখনই বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবেন বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন তিনি।

খুলনা গেজেট/ টিএ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!