জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ফুলতলা উপজেলার বেজেরডাঙ্গা ঐতিহ্যবাহী শাপলা নার্সারির স্বত্ত¡াধিকারী শেখ মনিরুল ইসলাম বন্যায় কয়েক দফা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পরেও নার্সারি করে সফল ও স্বাবলম্বী হয়েছেন । ১৯৮০ সালে এইচ এস সি পাশ করার পর বিভিন্ন জায়গায় চারাগাছের নার্সারি দেখে স্বপ্ন দেখেন মনিরুল ইসলাম।
বাড়ির আঙিনায় নিয়মিত বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ ও বনজ গাছের চারা রোপণ করে স্বল্প সময়ে বিক্রি করেন। মাত্র ৭ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেন চারা কলমের নার্সারি। তার সাফল্য দেখে গ্রামের আরও প্রায় শতাধিক উদ্যোক্তা নার্সারি গড়ে তোলেন। তিনি প্রথমে মেহগনি, একাশি ও আম গাছের চারা রোপণ করেন। কয়েক বছরের মধ্যে গাছের গুনগত মান ভালো হওয়ায় অনেকেই আসেন তার নার্সারির বাগান দেখতে। শুরুটা সখের বসে হলেও এক সময় আয়ের উৎসও হয় এই নার্সারি থেকে। সফলতার হাতছানিতেই নার্সারির প্রতি আগ্রহ জন্মাতে থাকে।
বর্তমানে ফুলতলার বেজেরডাঙ্গাতে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ফুলতলা উপজেলার বেজেরডাঙ্গা ঐতিহ্যবাহী শাপলা নার্সারির স্বত্ত্বাধিকারী শেখ মনিরুল ইসলামের ফুলতলার দক্ষিণডিহি এলাকার ১.৪৭ একর সম্পত্তি রয়েছে । এরমধ্যে ৪৬ শতক জমিতে মনিরুল ইসলাম বিভিন্ন গাছের চারা,কলম উৎপাদনসহ জমি ভোগ দখল করে আসছেন এবং বর্তমানে সেখানে চারা ও কলম রোপনকৃত রয়েছে। ৪/৫ একর জমিতেই বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা নিয়ে গড়ে তুলেছেন নার্সারি, যার নাম ‘শাপলা নার্সারি। ছোটবেলা থেকেই নার্সারি করার স্বপ্ন একসময় পূরণ হলেও সর্বনাশী বন্যায় সব স্বপ্ন ভেসে যায়।
১৯৮৬ সালে কয়েক দফা বন্যার পানিতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয় তার তিল তিল করে গড়ে তোলা নার্সারিতে। প্রায় বেশির ভাগ গাছই তলিয়ে যায় বন্যার পানির নিচে। সব গাছ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এক সময় সব কিছু শূন্য হয়ে যায়। তবুও স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি মনিরুল ইসলামের। আবারও শুরু করেন চারা গাছ রোপণ। স্বপ্ন দেখেন নতুনকরে নার্সারি করার। বিভিন্ন জায়গা থেকে গাছের চারা কলম সংগ্রহ করে এবার বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেন নার্সারি। পরিবারের অভাব অনটন থাকা সত্তে সত্ত্বেও গাছের প্রতি ভালবাসা থেকেই আবার ঘুরে দাড়ান তিনি। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই আবার সফলতার মুখ দেখতে পান। এবার স্বপ্ন যেন সত্যি পূরণ হয়েছে। মনিরুল ইসলামের বর্তমানে বেজেরডাঙ্গায় এবং দক্ষিণডিহিতে ৪/৫ একর জমিতে চারা কলম এর নার্সারি রয়েছে। এ নার্সারিতে ড্রাগন, রামবুটান, এভোকাডো, পিচ, আপেল, আঙুর, ক্রিসমাসট্রি, অর্জুন, আমলকি, হরিতকি, বহেরা, নিম, জয়তুন ও পাথরকুচি, বেলজিয়াম, মেহগনি, সেগুন ও রেইন্ট্রি, কৃষ্ণচূড়া এটোলিয়াম, নাইটকুইন, এ্যারোমেটিক জুঁই, তেজপাতা, দারুচিনি, গোলমরিচ, লবঙ্গ, এলাচি, ক্যাকটাস, ছাকুল্যান্টম, পাতাবাহার, এলোভেরিয়া, করবীসহ আরও হরেক রকম ফলজ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের চারা উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। এবছর তিনি বিভিন্ন ফলজ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের চারার পাশাপাশি বিদেশী ভিয়েতনাম ও বার্মার নারিকেল ও সুপারির চারা রোপণ করেছেন তার শাপলা নার্সারীতে।
এছাড়া বেজেরডাঙ্গায় দক্ষিনডীহি মৌজায় তার রয়েছে আলাদা করে চারা উৎপাদনের খামার। নার্সারির জনক শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, ১৯৯২ সালে তার নার্সারি থেকে তিনি পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। পরিবারের অভাব অনাটনেও কখনোই নার্সারির স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি। কয়েকবার বন্যার পানিতে গাছের চারা ভেসে যেয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয় তার নার্সারির। তার আপন ছোট ভাই শেখ শফিকুল ইসলাম রাজু ২০১৭ সালে ২১ সেপ্টেম্বর এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। ঠিক তার ১ বছরের মাথায় তার মা মৃত্যুবরণ করেন। মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পুণরায় শুরু করে দেন জিবন যুদ্ধ। তার স্বপ্ন কখনোই তাকে পিছনে ফিরতে দেয়নি। স্বপ্নবাজ হওয়ায় বার বার লোকসানের মুখে পড়েও নতুন করে শুরু করেছেন নার্সারি। তবে বর্তমানে তার বয়স বেড়ে যাওয়ায় তার আপন মেঝভাই ‘শেখ আব্দুল হাই” লেখাপড়া শেষ করে নার্সারিতে সর্বক্ষণ উৎপাদন ও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ৮ ভাই বোনদের ভিতর তিনিই বড়, গাছের চারা কলম বিক্রি করে ৫ বোন ও ২ ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে শ্রমিক, সার-কিটনাশক খরচ বাদে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা লাভ করছেন এই নার্সারি থেকে। গাছ লাগানো অতীব জরুরী গাছ মানুষকে অক্সিজেন দেয়, এজন্য প্রতিটা বাড়িতে বেশী করে গাছ লাগাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার যদি সহজ শর্তে বিনা সুদে নার্সারী গুলোকে কৃষি লোনের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে নার্সারির মালিকরা স্বাবলম্বী হতে পারবে পাশাপাশি বাংলাদেশে বেকারত্বও দূর হবে।
এ ব্যাপারে ফুলতলা উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শেখ মনজুর আলম জানান, মনিরুল ইসলামের নার্সারি এরই মধ্যে সৌখিন ব্যক্তি ও পেশাজীবীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকায় যারা নার্সারি করেছেন তাদের নার্সারি নিয়মিত পরিদর্শন ও পোঁকামাকড় আক্রমণ থেকে মুক্তির জন্য পরমার্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ২০২১ সাল থেকে সকল নার্সারী মালিকদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে। ফুলতলা উপজেলায় ৫ জন নার্সারী মালিককে এ নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে সকল নার্সারী মালিককে এ আওতায় আনা হবে।
উল্লেখ্য , শেখ মনিরুল ইসলাম বর্তমানে ন্যাশনাল নার্সারী সোসাইটি খুলনা জেলা কমিটির সভাপতি ।
খুলনা গেজেট/এমএম