ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে নামিদামি মেডিকেল কলেজেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন শত শত শিক্ষার্থী। ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বছরে এ প্রশ্ন ফাঁস হয়। এসব প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিয়ে দেশের প্রথম সারীর মেডিকেল কলেজগুলোর সঙ্গে খুলনা মেডিকেল কলেজেও ভর্তি হওয়ার সুযোগ মিলে যায়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির তদন্তে চিকিৎসা শিক্ষার এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
তদন্ত সংস্থা সিআইডি এরই মধ্যে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করেছে। প্রশ্নপত্র কিনে ভর্তি হওয়া এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত খুলনা মেডিকেল কলেজে ২০ শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন কলেজে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ফলও সংগ্রহ করছে সিআইডি। সম্প্রতি খুলনা মেডিকেল কলেজের সাবেক তিন শিক্ষার্থীকে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া কে বলেন, তদন্তে অনেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেসব শিক্ষার্থীর বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জোগাড়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন মেডিকেলে চিঠি পাঠানো সেই কাজেরই অংশ। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে।
মেডিকেল কলেজে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা বলেন, তালিকায় থাকা সেই ২২ মেডিকেল শিক্ষার্থী: ঢাকা মেডিকেল কলেজে এবং খুলনা মেডিকেল কলেজে পাঠানো পৃথক দুটি চিঠিতে ২২ শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে খুলনা মেডিকেলে তিন শিক্ষার্থীকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। অন্যদের সিআইডির নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
তালিকায় থাকা খুলনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুলনার আশিকুজ্জামান সানি ভর্তি হয়েছিলেন ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে। মেধা তালিকায় তিনি হয়েছিলেন ৬০১তম; কিন্তু ২০২২ সালের মে মাসে চূড়ান্ত প্রফেশনাল পরীক্ষায় ফেল করেন তিনি। এরপর আর পরীক্ষার টেবিলে বসেননি। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে মেধা তালিকায় ১১তম হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পিরোজপুরের মুসতাহিন হাসান লামিয়া। তিনি প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষায় ২০১৭ সালে অ্যানাটমি ও ফিজিওলজিতে ফেল করেন। দ্বিতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষা ২০১৮ সালে মেডিসিনে ফেল করেন। তবে ২০২১ সালে চূড়ান্ত প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাস করেন।
খুলনার আনিকা তাহসিন জেসি ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে মেধা তালিকায় ১৮২৩তম হয়ে ভর্তি হন। ২০২০ সালের নভেম্বরে পাস করেন তিনি। খুলনার শর্মিষ্ঠা মণ্ডল ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ১৮২৩তম হয়ে ভর্তি হন। পাস করেছেন ২০২২ সালে। খুলনার আসমাউল হুসনা নিহা ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ২২৪১তম হয়ে ভর্তি হন। পাস করেছেন ২০২২ সালে। খুলনার নূরে মার্জিয়া ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ২১১০তম হয়ে ভর্তি হন। ২০২০ সালে তিনি চূড়ান্ত প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাস করেন। যশোর সদরের ফারিহা ইসলাম ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন। পাস করেছেন ২০২১ সালে।
খুলনার রেমী মণ্ডল ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে পাস করেছেন ২০২১ সালের নভেম্বরে। খুলনার নাজিয়া মেহজাবীন ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ১৩৫৬তম হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। পাস করেছেন ২০২১ সালের মে মাসে। খুলনার মো. সোহানুর রহমান বিশ্বাস ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন। মেধা তালিকায় তিনি ছিলেন ২১৯৫তম। ২০২২ সালের মে মাসে চূড়ান্ত প্রফেশনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফেল করেন। গত নভেম্বরে আবার পরীক্ষা দিয়েছেন। ফল এখনো প্রকাশ হয়নি। রাজশাহীর আরাফাত হোসেন ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ২০৯২তম হয়ে ভর্তি হন। ২০২২ সালের চূড়ান্ত প্রফেশনাল পরীক্ষায় ফেল করেন। নভেম্বরে আবার পরীক্ষা দিয়েছেন। তার পরীক্ষার ফলও প্রকাশ হয়নি।
গত ২০ আগস্ট প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাদের মধ্যে এ তালিকায় রয়েছেন তিনজন। তারা হলেন নাজিয়া মেহজাবীন, শর্মিষ্ঠা মণ্ডল ও মুসতাহিন হাসান লামিয়া।
মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ছাত্রদের কাছে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগে থ্রি ডক্টরসের মালিক ডা. মো. ইউনুচ উজ্জামান খান তারিমকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। তার কোচিং সেন্টারের এক্সাম ব্যাচে ভর্তি হলেও পড়েননি বলে দাবি করেছেন খুলনা মেডিকেলের তালিকায় থাকা আসমাউল হুসনা নিহা।
প্রশ্ন কিনে ভর্তির অভিযোগ প্রসঙ্গে আসমাউল হুসনা নিহা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। খুলনার থ্রি ডক্টরসের ডা. তারিম স্যারের কাছে আমি পড়ি নাই। আমি তারিম স্যারের থ্রি ডক্টরসের এক্সাম ব্যাচে ভর্তি হয়েছিলাম; কিন্তু সেটা চালিয়ে যাইনি। আমি পড়েছি আমাদের কলেজের সিনিয়রদের কাছে। যারা কখনো তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। এই জিনিসটা যাদের বলার বলে দিয়েছি।’
খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. দীন-উল ইসলাম বলেন, ‘১১ শিক্ষার্থীর নাম দিয়ে তাদের একাডেমিক বিষয়ে তথ্য চেয়েছিল সিআইডি। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে পাঠিয়েছি। আমরা যখন সিআইডিকে তথ্য পাঠিয়েছি, তখন আটজন পাস করে বের হয়েছে, তিনজনের ফল প্রকাশ তখনো বাকি ছিল। তারা সময়মতো পাস করতে পারে নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কেউই এই বিষয়টা সমর্থন করি না। যেখানে একটা ছেলেমেয়ের সারা জীবনের স্বপ্ন থাকে যে, সে মেডিকেলে পড়বে। ছোটবেলা থেকেই সেভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অনেক পরিশ্রম করতে হয় তাদের। এই অবস্থায় কেউ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কিনে তাকে বাইপাস করে এগিয়ে যায়, ভর্তি হয়, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এখন যদি ১০ জন ছাত্রও এভাবে ভর্তি হয়, তাহলে ১০ জন মেধাবী ছেলে বঞ্চিত হয়। অবশ্যই তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত। তবে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে, তাদের আরও কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।’
খুলনা গেজেট/এইচ