‘আগে সিঙ্গা লাগাতাম, মানুষ তেমন গুরুত্ব দিতো না। পেতাম ১০০-৩০০ টাকা। এতে আমাদের হতো না। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। এখন আমরা ব্যবসা করি। শাড়ি-কাপড় বিক্রি করি। আগে মানুষ আমাদের জায়গা দিত না। এখন সবাই আমাদের স্নেহ করে, ভালোবাসে। ডেকে মানুষ ঘরের ভেতরেও নেয়। এখন আয়ও বেড়েছে।’
এভাবেই এই প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন খুলনার জোড়াগেট এলাকার গ্রীনল্যান্ড পল্লিতে থাকা বেদে সম্প্রদায়ের লাকী বেগম।
লাকী বলেন, আমি কাজে গেলে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা লাভ থাকে। এই টাকা দিয়ে আমি আবার কাপড় আনি আর বিক্রি করি। এখন অনেক সুবিধা আছে।
শুধু লাকী বেগমই নয়, তার মতো যাযাবর জীবন ছেড়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরছে বেদে সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা। বিভিন্ন জনপদে ঘুরে ঘুরে সাপ খেলা, সিঙ্গা লাগানোর কাজ ছেড়ে এখন নিজেরাই হয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এক সময়ের যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের এখন স্থায়ী বসতি বিভিন্ন জেলায়। একইসঙ্গে এই সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে অবসান হয়েছে শিক্ষাহীনতা। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে তাদের নতুন প্রজন্ম। প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে অনেকে এখন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত।
খুলনার বেদে সম্প্রদায়ের মেয়ে ইসমা খাতুন বলেন, আমার বাবা-মা সাপের খেলা দেখাত, সিঙ্গা লাগাত, দাঁতের পোকা ফেলাত। তারা চেয়েছিল তারা অনেক কষ্ট করেছে, তাদের ছেলে মেয়েকে এই পেশায় রাখবে না। যার জন্য তারা স্থায়ী বসতি গড়ে আমাদের ৬ ভাই-বোনকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমার ভাই এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি শুধুমাত্র অর্থের জন্য। সে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করে।
তিনি বলেন, আমার বাবা-মা জানতেন এটা কোন জীবন না, ওই কাজ করলে প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে হয়, সবাই উপহাস করে। আমি মনে করি এখনও যারা ওই করে তারা যেন ছেড়ে দেয়।
ইসমা বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। আমরা ৬ ভাই-বোন। আমার মা-বাবার তেমন আয় ছিল না। আমাদের কষ্ট হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের তেমন আয়ও ছিল না।
পাশাপাশি ছোট চার ভাই বোনদের শিক্ষার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। আমাদের সস্প্রদায়ের অনেকেই এখনও আগের পেশায় রয়েছে। আমরা অনেকে সুযোগ পেয়েছি, তারা হয়তো সুযোগ পাচ্ছে না। সবাই সুযোগ পেলে সমাজের মুল ধারায় ফিরবে বলে তিনি আশাবাদী।
এদিকে খুলনার ওই বস্তির বেদে সম্প্রদায়ে অধিকাংশ মানুষ এখন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোট উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন। তাদের দেখাদেখি এখনও যারা বেদেদের আদী পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন তারাও উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছেন।
বেদে সম্প্রদায়ের উদ্যোক্তা কেয়া খাতুন বলেন, আগে আমার বাবা-মা সিঙ্গা লাগাতো। এখন আর এসব করে না। সহায়তা ও প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর কেউ কাপড়ের ব্যবসা করে, কেউ ব্যাগের ব্যবসা করে। আগের ওই কাজ করলে সমাজে মানুষের কাছে মূল্য পাওয়া যায় না, মানুষ মিসতেও চায় না। এখন মর্যাদা পাওয়া যায়।
কেয়া বলেন, আমি আগে অন্যের ব্যাগ বানাতাম। এখন নিজের ব্যাগ বানাই। নিজের কাজ নিজে করি। গড়ে তুলেছি সানজিদা ব্যাগ ঘর। এখানে আমার সাথে আরও ২ জন কাজ করে। এখন ভালো আছি। ভবিষ্যতে এর চেয়ে ভালো পর্যায়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শেখাবো, যেন তারা কষ্ট না করে। ভালো পর্যায়ে যায়, চাকরি করবে।
বেদে ওমর ফারুখ বলেন, আগে সিঙ্গা লাগাতাম, সাপের খেলা দেখাতাম। কাজ ভালো ছিল না, ঝুঁকি ছিল। মানুষ ধিক্কার ও বেশি বেশি সমালোচনা করতো। খারাপ জানতো, অনেকে রাগ করে তাড়িয়ে দিতো, অপমান করতো। আবার অনেকে ভালো জানতো। আমরা চাচ্ছিলাম যে এই কাজ যাতে আমরা না করি। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে পেরে উঠছি না। আমরা যে পেশা করছি, যাতে ছেলে মেয়ে না করে সে জন্য অন্য পেশায় আছি। এখন আমি শাড়ি-কাপড় বিক্রি করছি। এতে ৫০০ টাকা বিক্রি করলে ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন সহযোগিতা সমাজের মূল স্রোতে যুক্ত হচ্ছে বেদে সম্প্রদায় বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
রূপান্তরের স্ক্রিন প্রকল্পের ফিল্ড অফিসার টুকু রানী বিশ্বাস বলেন, বেদে সম্প্রদায় আগে দাঁতের পোকা ফেলানো, সিঙ্গা লাগানো, সাপ ধরা, সাপ খেলা দেখানো কাজগুলো করতো। কিন্তু দিন দিন এই কাজের চাহিদা কমে গেছে। এখন আর এসব কেউ বিশ্বাস করতে চাই না। ফলে এদের (বেদে) আয় কমে আসছে। এ জন্য যাচাই-বাছাই করে ১০ দিনের একটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাদের মধ্যে ১৮ জনকে আমরা ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছি। এই টাকা পেয়ে তারা কেউ ছাগল পালন, কেউ হাঁস-মুরগি পালন করছে। কেউ কাপড়ের ব্যবসা করছে, কেউ সেলাই মেশিন কিনে কাজ করছে, কেউ কেউ মুদি ব্যবসা, সবজি ব্যবসা করছে। কেউ সিমেন্টের ব্যাগ তৈরি করছে। অনেকে আগে অন্যের কারখানায় ব্যাগ তৈরি করতো। এখন টাকা পেয়ে নিজেই ব্যাগ তৈরি করে বিক্রি করছে।
তিনি বলেন, প্রত্যেকে টাকা পেয়ে সঠিকভাবে ব্যবসা শুরু করেছে। তাদের কাজ দেখে আমরা সত্যিই হতবাক হয়েছি যে এতো সুন্দর কাজ তারা করতে পারবে, ধারণাই করতে পারিনি। তাদের (বেদে) একটিই কথা আমরা যখন সামনের দিকে পা একবার দিয়েছি, পিছপা হবো না। বাপ-দাদার পুরনো পেশা সিঙ্গাও অনেকে পুড়িয়ে ফেলেছে। ভাসমানভাবে আরও অনেক স্থানে বেদে সম্প্রদায় রয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতে আনা সম্ভব।
খুলনা গেজেট/এমএম