ঝুলন্তপাড়া : ‘জন্ম যেখানে আজন্ম পাপ’ শিরোনামে ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর জনপ্রিয় অনলাইন খুলনা গেজেটে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে সরেজমিনে দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগী ঝুলন্তপাড়ার বাসিন্দাদের দুঃখ দুর্দশা তুলে ধরা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে খুলনা গেজেটের মাধ্যমে পাঠকেরা জানতে পারেন কতটা দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন ঝুলন্তপাড়ার বাসিন্দারা। আর সংবাদটি প্রকাশের পর বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংগঠনসহ অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে ওই মানুষগুলোর পাশে দাড়ানোর ইচ্ছেপোষণ করেন। ইতোমধ্যে একটি সামাজিক সংগঠনসহ বেশ কিছু মানুষের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ঝুলন্তপাড়ায় একটি মিঠাপানির পুকুর পুনঃখনন করা হয়েছে। পাশাপাশি একটি মসজিদ পুনঃনির্মাণের কাজ চলছে। মসজিদটি দোতলা বিশিষ্ট তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে পরবর্তীতে দুর্যোগকালীন সময়ে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পুকুর খনন এবং মসজিদ নির্মাণ হওয়ায় অনেকটাই উপকৃত হবেন বলে জানিয়েছেন এই জনপদ।
২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর জনপ্রিয় অনলাইন খুলনা গেজেটে “ঝুলন্তপাড়া : ‘জন্ম যেখানে আজন্ম পাপ’ শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশের পরই প্রথমে শীতকালীন কম্বল বিতরণের উদ্যোগ নেন খুলনার সোনামুখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কামরুল ইসলাম। আর তার সাথে যুক্ত হন ঢাকাস্থ সংগঠন মেহমানখানাসহ ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই। ২০২৩ সালের পহেলা জানুয়ারি ঢাকা থেকে সরাসরি ঝুলন্তপাড়ায় গিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে কম্বল বিতরণ করেন তারা। এরপর অঞ্চলটি ঘুরে দেখে সোনামুখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কামরুল ইসলাম উদ্যোগ নেন একটি মিঠা পানির পুকুর খননের। পাশাপাশি একটি মসজিদ কাম সাইক্লোন সেল্টারের পুনঃনির্মাণের উদ্যোগও নেন তিনি। দোতলা বিশিষ্ট মসজিদের জন্য ব্যয় ধরা হয় ২৫-৩০ লাখ টাকা। শুরু করেন অর্থ সংগ্রহের কাজ। তার সোনামুখ পরিবারের পাশাপাশি অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত হন এ কাজের সাথে। মিঠা পানির পুকুর পুনঃখননের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আর মসজিদের একতলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজও প্রায় শেষ।
দাকোপের সুতারখালী ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ড জুড়ে এই ঝুলন্তপাড়া। এই দুই ওয়ার্ডের মাঝামাঝি স্থানেই তৈরি করা হয়েছে মসজিদ ও পুকুরটি। যাতে সকলেই এর দ্বারা উপকৃত হতে পারেন। ইতিমধ্যে এখানকার অনেকেই পুকুর থেকে সরাসরি পানি নিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহার করছেন।
ঝুলন্তপাড়ার ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোঃ খোকন সানা বলেন, পুকুরটি পুনঃখনন করে আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। আমাদের এখানে খাবার পানির খুব সংকট। এখন যেহেতু বৃষ্টির সময় আমরা বৃষ্টির পানিই ধরে রাখি খাওয়ার জন্য। কিন্তু শুকনোর সময় অনেক কষ্ট হয়। ৫০ পয়সা করে এক লিটার পানি কিনে খাইতে হয়। আশা করি এবারে শুকনোর সময় আর পানি কিনে খাওয়া লাগবে না। এই পুকুর থেইকেই পানি পাওয়া যাবে। এই পুকুরের পানি এখন সবাই রান্নার কাজে ব্যবহার করছে। আবার যারা জঙ্গলে বা নদীতে যাচ্ছে তারাও এখান থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছে। আর মসজিদটি নির্মাণ হওয়ায় এলাকার অনেক মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করতে পারবে।
সুতারখালী ইউনিয়নের ৯নং কালাবগী ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নিমাই কুমার রায় বলেন, আমার ওয়ার্ডেই পুকুর এবং মসজিদের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে সবাই ওই পুকুরের পানি দিয়ে রান্নার কাজ করছে। কালাবগী নতুন বাজার জামে মসজিদের কাজও চলছে। এটা এখানকার মানুষের জন্য একটি বড় পাওয়া। যারা এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
একই ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ মহসিন বলেন, এখানকার মানুষের পানির সমস্যা খুব। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হয় খাওয়ার জন্য। আর শুকনো মৌসুমে ৩০ পয়সা করে পানি কিনতে হয়। শুকনো মৌসুমে পুকুরে যদি পানি থাকে তাহলে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ অনেকটা কমবে। তখন আর কাউকে পানি কিনে খেতে হবে না।
এ মহৎ কাজের উদ্যোক্তা সোনামুখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কামরুল ইসলাম বলেন, খুলনা গেজেট অনলাইনে একটি সরেজমিন প্রতিবেদনে ওই এলাকার মানুষের কষ্টের কাহিনি পড়েছিলাম। তাই তীব্র শীতে শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে বছরের শুরুতেই কয়েকজনের সহযোগিতায় কম্বল নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম ওই দুর্গম এলাকায়। এরপর ওখানকার মানুষের দুরাবস্থা দেখে উদ্যোগ নিই মিঠা পানির পুকুর খননের এবং মসজিদ কাম সাইক্লোন সেল্টার তৈরির। একে একে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। সকলের সাহস পেয়ে শুরু হয় কাজ। পুকুরের কাজ শেষ হয় ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে। মসজিদ নির্মাণের কাজ এখনও চলছে। একতলা ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ কাজে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ২৫-৩০ লাখ টাকা। এখনও ১৫ লাখ টাকার ঘাটতি রয়েছে। আরও সাপোর্ট পেলে আল্লাহর রহমতে এবং সকলের সহায়তায় অতি দ্রুত দোতলা মসজিদ কাম সাইক্লোন সেল্টার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে। অবহেলিত এলাকার মানুষের মুখে হাসি ফুটবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে ভাল লাগছে পুকুরটা করতে পেরে। ওখানকার মানুষের খাবার পানির জন্য যে হাহাকার দেখেছি সেটি যদি লাঘব করতে পারি তাহলে এর থেকে ভাল আর কি হতে পারে। পরবর্তীতে ওখানে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও কাজ করার ইচ্ছে পোষণ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষ জনপদ এই কালাবগী ঝুলন্তপাড়া। খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড জুড়ে ঝুলন্তপাড়ার পরিধি। খুলনা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিঃ মিঃ দূরে এলাকাটির অবস্থান। শিবসা নদীর চরে গড়ে তোলা অসংখ্য টংঘরে এ জনপদের বসবাস। এর পূর্বে ভদ্রা, পশ্চিমে শিবসা নদী আর ওপারে সুন্দরবন। এখানে প্রায় ৪শ’ পরিবারের বসবাস। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর নদী ভাঙনে কবলিত এ এলাকার মানুষের দূর্ভোগের কোন শেষ নেই। নিরন্তুর সংগ্রামই এখানে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এখানে ভাল থাকা মানে তিনবেলা পেটভরে ভাত খাওয়া আর একটু নিশ্চিন্তে ঘুমানো।
১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর এই এলাকায় ঝুলন্ত ঘর তৈরি শুরু হয়। তারপর থেকে এর নাম হয় ঝুলন্তপাড়া। কয়েক দফা নদীভাঙনে বসতি ও জমি চলে গেছে শিবসা নদীতে। সিডর ও আইলার আঘাতে বসতভিটা আর রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় পাড়াটির পরিধি আরও বেড়েছে। এদিকে সরকার নদী থেকে পোনা আহরণ নিষিদ্ধ করায় এবং বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় জীবিকার তাগিদে অনেকেই পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন।
খুলনা গেজেট/এমএম