সীমান্তবর্তী জেলা হাওয়ায় ঘাতক ব্যাধি এইচআইভি এইডস এর ঝুঁকিতে সাতক্ষীরার মানুষ। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন,, বিড়ম্বনা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা জেলার হাসপাতালগুলোতে না থাকায় এটির সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাচ্ছে না। চলতি বছরের সাত জন এইডস পজেটিভ সহ শতাধিক রুগী খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এআরটি (এন্ট্রাি রেট্রোভাইরাল থেরাপি) সেন্টারে থেরাপি নিচ্ছেন।
জেলায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে পারে এমন ভীতি থেকে রোগের কথা গোপন রাখেন অধিকাংশ রোগী। এইডস সম্পর্কে ভুল ধারণা ও সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে অনেকে চিকিৎসা নেন না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
বিদেশ ফেরত, হিজড়া জনগোষ্ঠী, এমএসএম, যৌনকর্মী ও ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় মরণবেদী এইচআইভি এইডসে। দেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়া এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পরিস্থিতি বিবেচনায় যেকোনো সময় দেশে এইডস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৭ সালে জেলায় এইচআইভি পজিটিভ ছিল ৭৪ জন। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এরপর জেলা ব্যাপী কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। জেলায় ১০৫ জন হিজড়া, ৭০০ জন এমএসএম এবং ৮৪৯ জন যৌনকর্মী রয়েছে।
লাইট হাউজের সাব ডিআইসি ইনচার্জ মোঃ সঞ্জু মিয়া বলেন, সারাদেশে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সরকার। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। একসময় নারী মুক্তি এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন ২০১৩ সালের আগে এইডস নিয়ে কাজ করতো। এরপর তাদের প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা আর কাজ করে না। হিজড়া, এমএসএম, যৌনকর্মী ও ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীদের নিয়ে এখন জেলায় তিনটি এনজিও কাজ করে। আমরা এমএসএম ও হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করি। এই ডিসেম্বরে আমাদের প্রকল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে। ‘মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ” নামে একটি সংস্থা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীদের নিয়ে কাজ করে। ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন’ নারী যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করেন।
তিনি আরও বলেন, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এইডসের ঝুঁকিতে ভারত। ওই দেশের রোগীর সংখ্যা অনেক। সাতক্ষীরার মানুষ খুব সহজে ভারতে যাতায়ত করে। তাদের মধ্যে কি পরিমাণ মানুষ এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হচ্ছে সেটা বোঝা যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। এই পরীক্ষা জেলার হাসপাতালগুলোতে নেই এবং সহজে করা যায় না। এছাড়া সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ ও বিড়ম্বনার ভয়ে অনেকে রোগ পুষে রাখেন কিন্তু কাউকে বলেত চালনা বা চিকিৎসা করায় না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে হিজড়া, এমএসএম রোগীদের পরীক্ষার মাধ্যমে খুলনা মেডিকেল রেফার করে চিকিৎসার সুযোগ দিয়ে থাকি। এটি রোধে সচেতনার বিকল্প কিছু নেই। এছাড়া আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সচেতনামূলক কার্যক্রম করে থাকি।
এ্যাডাব সাতক্ষীরা জেলার সভাপতি ও স্বদেশের পরিচালক মাধব চন্দ্ৰ দত্ত বলেন, এই অঞ্চলের বহু সংখ্যাক মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে গমণ করেন। বিশেষ করে নারীরা বাসা- বাড়িতে কাজের জন্য এবং পুরুষ শ্রমিকরা ভাটায় কাজ করতে যান। তারা অনেকে এই মরণ ব্যাধি নিয়ে দেশে ফিরছেন। অনেকে মৃত্যুবরণও করছেন। রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ায় এটির ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোমরা বন্দর দিয়ে প্রতিদিন শতশত ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভারা এসে সেখানে রাত্রি যাপন করে। তাদের কারণেও অনেক ঝুঁকিতে সাতক্ষীরা।
তিনি আরও বলেন, এই জেলায় অনেক রোগী আছে কিন্তু পরীক্ষা হয় না, সেকারণে সঠিক চিত্র জানা যায় না। সে কারণে দাতা সংস্থাগুলো সরে যাচ্ছে। অর্থ না থাকায় উন্নয়ন সংস্থাগুলো সচেতনামূলক কার্যক্রম না করায় এটি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে অনেকগুলো উন্নয়ন সংগঠন এইডস সম্পর্কে মানুষকে সচেতনার কাজ করতো। কিন্তু দাতা সংস্থাগুলো আর অর্থায়ন করছে না। হাতে গোনা দুই-একটি সংস্থাকে এটি নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। অনেকের প্রকল্প এই বছরেও শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেহেত এটি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের উচিত এটি নিয়ে আরও ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা। এইডস নিয়ে আরও বেশি বেশি প্রকল্প দেওয়ার দাবী করেন তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডাঃ সুব্রত ঘোষ বলেন, এইচআইভি এইডস একটি সংক্রামক রোগ। এইচআইভি একটি ভাইরাস যা মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। যা শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। এইডস নামের রোগের ভাইরাস সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালের ৫ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ধরা পড়ে। ১৯৮৪ সালে থাইল্যান্ডে, ১৯৮৬ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে এবং বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে এ রোগ দেখা দেয়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ পরে কিছু কিছু নাই নিৰ্দষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন- জ্বর, গলাব্যথা, মাথাব্যাথা, মুখের অভ্যন্তরে ঘা, দীর্ঘমেয়াদি কাশি, স্বাস্থ্যের অবনতি, লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠা ইত্যাদি। এইডস রোধকল্পে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রাণঘাতী এই রোগ প্রতিরোধে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। ইনজেকশন নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবারই নতুন সুচ/সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে। এইডস থেকে মুক্ত থাকতে ঝুঁকিপূর্ণ শারিরীক মিলন হতে বিরত থাকতে হবে।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা: মোঃ সবিজুর রহমান বলেন, জেলার হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় না। এখানে কোন রোগী আসলে খুমেক হাসপতালের এআরটি সেন্টারে রেফার করে থাকি। অধিকাংশ মানুষ এইডস হলেও বলতে চাননা। সেকারণে এর সঠিক পরিসংখ্যান আমরা জানতে পারি না। এটি নিয়ন্ত্র করতে সঠিক তথ্য জানা প্রয়োজন। এইডস হলেই মানুষ মৃত্যুবরণ করে, এটি ভুল ধারণা। এআরটি (অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি) নিলে রোগি সুস্থভাবে অনেক বছর বেঁচে থাকে। সরকারিভাবে ওষুধ বিনামূলে প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়, আইআরডিডিআরবি, উন্নয়ন সংগঠন লাইট হাউজ, সেভ দ্যা চিল্ড্রেনসহ বিভিন্ন বেরকারি উন্নয়ন সংগঠন কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, এইডস একটি মারাত্মক সংক্রমক রোগ। প্রাণঘাতী এই রোগ প্রতিরোধে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। এইডস থেকে মুক্ত থাকতে ঝুকিপূর্ণ যৌনমিলন হতে বিরত থাকতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের বিবেচনায় এইডস বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য ভোমরাসহ সীমাবর্তী এলাকায় ও বিদেশ গমনকারীদের বাধ্যতামূলক এইডস পরীক্ষা করাতে হবে। এইডস প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতার বিকল্প কিছু নেই। সেজন্য আমাদের “সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
খুমেক হাসপাতালের এআরটি সেন্টারের কাউন্সিলর কাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দিবেশ ওঝা বলেন, চলতি বছরে আমাদের সেন্টারে ৯২৩ জনের পরীক্ষা করে নতুন পজেটিভ ৬৫ জনের মধ্যে সাতক্ষীরার ৭জন রয়েছে । এর মধ্যে নারী ৫, শিশু এক ও পুরুষ একজন। ২০২১ সালে এই সেন্টারে ৯২৯ জনের পরীক্ষা করে ২৮জনের এইডস শনাক্ত হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবেশি দেশ ভারতের কারণে সাতক্ষীরা জেলাও ঝুঁকিতে আছে। আমাদের এখানে যেসকল পজেটিভ রোগী চিকিৎস সেবা নেয় তাদের মধ্যে অধিকাংশ সাতক্ষীরা, যশোর এবং নড়াইলের। খুলনা ও বাগেরহাটের কিছু রোগী আছে। চলতি বছরে খুলনা বিভাগে মারা গেছে ১৮জন। তার মধ্যে সাতক্ষীরার কেউ নেই। পজেটিভ ৫১৫ রোগীর মধ্যে ৪১০জন নিয়মিত চিকিৎসা সেবা নেয়। তাদের মধ্যে শতাধিক সাতক্ষীরার রোগী আছে। আরও অসংখ্যা পজেটিভ রোগী আগে তারা পরীক্ষা করায না সে কারণে আমরা সনাক্ত করতে পারিনা। এই এলাকার অনেক নারী যারা ভারতে যায় তারা এই রোগে আক্রান্ত। যারা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে হাসপতালে ভর্তি হয় তাদেরকে আমাদের কাছে রেফার করে তখন আমরা জানতে পারি। জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা নিরিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে এর সঠিক চিত্র জানা যাবে। ইতিমধ্যে সরকার বিভিন্ন জেলায় ২২টি সেন্টার করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
প্রসঙ্গত, মরণ ব্যাধি এইডসের ব্যাপারে মনুষের মাঝে সতেনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর ১ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক এইডন দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।