সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে ছেচল্লিশ বছর আগে বাড়ির সামনের পুুকুরে ডুবে মৃত্যু হয় ছয় বছরের শিশু খোকন গাজীর। পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয় বয়স্ক ব্যক্তিবর্গ মরহুম গোলাম আহমদ গাজীর শিশু ছেলের সে মৃত্যুর ঘটনা স্বীকারও করেন। অথচ চার দশক পরে এসে মৃত ওই শিশুর সহোদর আব্দুস সাত্তার নিজেকে খোকন গাজী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপরতা শুরু করেছেন।
ইতিমধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনু-বিভাগে লিখিত আবেদন জানিয়ে নিজ নামসহ জম্ম তারিখ পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন তিনি। এমনকি সন্তানদের জম্মসনদ আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রেজিষ্ট্রেশনসহ স্ত্রী ও নিজ নামে জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে মৃত ভাইয়ের নাম ব্যবহার করেছেন। মূলত খোকন গাজীকে জীবিত প্রমানের অপকৌশল হিসেবে ২০১৫ সালের পর থেকে আব্দুস সাত্তার এসব জালিয়াতির কার্যক্রম শুরু করেন। এমনকি তিনি দুটি ভিন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র নিজের কাছে সংরক্ষিত রাখার সুযোগে ক্ষেত্র বিশেষ তা ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ।
আলোচিত এ ঘটনায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে চাঞ্চল্যেও সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ স্বার্থ হাসিলে প্রায় ৪৩ বছর পরে এসে আলোচিত আব্দস সাত্তার নিজ নাম-পরিচয়সহ জম্ম তারিখ পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ জালিয়াতির সাথে জড়িত চক্রটিকে আইনের আওতায় নেয়ার জন্য আলআমিন হোসেন ও আমিরুল ইসলাম নামের দুই ব্যক্তি নির্বাচন কমিশন, বিভাগীয় কমিশনারসহ শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭২ সালে উপজেলার শ্রীকৃষ্ণপুর মৌজায় খোকন গাজীর নামে তার পিতা গোলাম আহমদ প্রায় ৩ একর জমি দান করেন। ছয় বছর বয়সে শিশুটির মৃত্যু হলে তিনি একই জমি নিজ মেয়েকে দানপত্র করে দেন। প্রায় ৪৩ বছর পরে এসে ২০১৫ সালে আকস্মিকভাবে আব্দুস সাত্তার নিজেকে খোকন গাজী দাবি করে তার পুরো নাম আব্দুস সাত্তার খোকন বলে প্রচার করে। এসময় নিজেকে মৃত খোকন গাজী প্রমান করতে তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদসহ থেকে ‘আব্দুস সাত্তার খোকন’ নামে নুতনভাবে নাগরিক সনদপত্র সংগ্রহ করেন। এক পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচন অফিসের এক সহকারীর সহায়তায় আব্দুস সাত্তার খোকন নামে নুতন আরও একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করেন। বিষয়টি জানাজানির পর নির্বাচন অফিসে অভিযোগ হলে জালিয়াতি করে প্রস্তুতকৃত আব্দুস সাত্তারের নুতন ওই জাতীয় পরিচয়পত্র আটকে দেয়া হয়।
আলআমিন হোসেন জানান, জম্মের পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিয়ের কাবিননামা এমনকি ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সর্বত্র তার নাম আব্দুস সাত্তার নাম ছিল। পরবর্তীতে নিজের নামের সাথে খোকন গাজী সংযুক্ত করার অভিপ্রায়ে তিনি নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনু-বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরে নিজেকে আব্দুস সাত্তার খোকন গাজী দাবি করে পুর্বের কাগজপত্র সংশোধনের আবেদন করেন। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তরের জাল প্রত্যায়নপত্র তৈরী করেন। মৃত ভাইয়ের (খোকন গাজী) নামীয় ৩ একর সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য আব্দুস সাত্তার এমন জালিয়াতির কান্ড ঘটিয়েছে। ২০১৫ সালে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালকের দপ্তরে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করেন। এসময় তিনি নিজেকে আব্দুস সাত্তারের পরিবর্তে আব্দুস সাত্তার খোকন এবং জম্ম তারিখ ১১/০৬/৭৭ এর পরিবর্তে ১১/০৬/৭১ বলেও দাবি করেন।
অ্িযভযোগকারি ডাঃ আমিরুল ইসলাম জানান, স্ত্রীসহ নিজের ভোটার তালিকায় তার নাম আব্দুস সাত্তার রয়েছে। একই নামে একটি নিকাহনামা থাকা সত্ত্বেও সদ্য প্রস্তুতকৃত অপর নিকাহনামায় আব্দুস সাত্তার খোকন উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া নুতন জাতীয় পরিচয়পত্রের আবেদনের সাথে সংযুক্ত জম্ম সনদসহ ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যায়নপত্র, ওয়ারেশকায়েম সনদ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেনীর প্রত্যায়নপত্রে আব্দুস সাত্তার খোকন উল্লেখ করা হয়েছে। যার সবগুলোই দ্বিতীয় বারের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার চেষ্টায় তাৎক্ষনিকভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রস্তুতকৃত।
তারা আরো জানান, মৃত ভাইয়ের নামে থাকা মুল্যবান সম্পত্তি আত্মসাতের লক্ষ্যে আব্দুস সাত্তার নাম পরিবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০০৯ সালে ভূমি অফিস কতৃক জমির মালিকানা হিসাব বিবরণী তিনি আব্দুস সাত্তার নামে বুঝে নিলেও ২০১৪ সাল থেকে তিনি মৃত খোকন গাজীর নাম পরিচয় বহনের চেষ্টা করছে। বর্তমানে আব্দুস সাত্তার ও আব্দুস সাত্তার খোকন নামের দুটি ভিন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র তিনি ব্যবহার করছে বলেও তাদের দাবি।
আব্দুস সাত্তারের দুই ভাই আবু ইব্রাহিম ও ওসমান গনি জানান, তাদের ভাই খোকন গাজী ছয় বছর বয়সে মারা যায়। তারপরও কেন কি উদ্দেশ্যে তাদের অপর ছোট ভাই আব্দুস সাত্তার নিজের নামের সাথে নুতন করে খোকন গাজী জুড়তে চাইছে বলতে পারবোনা।
অভিযুক্ত আব্দুস সাত্তার জানান, জম্মের কয়েক বছরের মধ্যে মারা গেলেও ওই ভাইয়ের নাম তার মনে নেই। তবে এক পর্যায়ে তিনি দাবি করেন মৃত ভাইয়ের জমি রক্ষার জন্য ভাই-বোনদের পরামর্শে তিনি খোকন গাজী হতে সম্মত হয়েছিলেন।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাচন অফিসার মোঃ রবিউল ইসলাম জানান, দ্বিতীয়বার জাতীয় পরিচয়পত্র লাভের চেষ্টায় আব্দুস সাত্তার অসৎ পন্থা অবলম্বন করেছেন। যে কারনে তার আবেদন বাতিল করে আব্দুস সাত্তারকে তার প্রথম জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহের সুপারিশ করা হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এনএম