সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে সদ্য নির্মিত রিংবাঁধ ভেঙ্গে ও পূর্বের ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকে ওই দুই উপজেলার কমপক্ষে ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ভেসে গেছে হাজার হাজার বিঘা মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ।মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নে।
কেউ মারা গেলে মাটি দেয়ার মত ফাঁকা জায়গা টুকু নেই ওই ইউনিয়নে। একই সাথে দেখা দিয়েছে খাবার পানির তীব্র সংকট। সম্পূর্ন ভেঙ্গে পড়েছে এলাকার স্যানিটেশন ব্যবস্থা। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। ইউনিয়নে এমন কোন বাড়ি নেই যে, নদীতে জোয়ারের সময় ওই বাড়িতে বুক সমান পানি উঠছে না। কষ্টের যেন শেষ নেই মানুষের।
প্রতাপনগর গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বৃহস্পতিবার রাতে চাচাতো ভাই আব্দুস সালাম মারা গেছেন। তার দাফনের জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা ইউনিয়নের কোথায় না পেয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে খাজরা খেয়া ঘাটে দাফন করেছি। একই ভাবে প্রতাপনগর গ্রামের বাহার মাষ্টার সাতক্ষীরার সিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান। গ্রামে দাফনের জায়গা না থাকায় তাঁকে শহরের রসুলপুর সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে টানা বৃষ্টির সঙ্গে নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতাপনগর ইউনিয়নের কোলা ও হরিষখালী এলাকার নতুন নির্মিত বিকল্প রিংবাঁধ ভেঙ্গে এবং চাকলা, কুড়িকাউনিয়া ও শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালী পূর্বর ভাঙ্গন পয়েন্টে দিয়ে হু হু করে লোকালয়ে পানি ঢুকে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে জোয়ার-ভাটা বইছে প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের পুরো এলাকায়। এই দুই ইউনিয়নে ভেঙ্গে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। সুপেয় পানির সকল উৎস নদীর লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে খাবার পানির তীব্র সংকট।
এদিকে বৃহস্পতিবার ভেঙ্গে যাওয়া গাবুরা ইউনিয়নের ১৫ নং পোল্ডারের নেবুবুনিয়া এলাকার বাঁধের ছয়টি পয়েন্ট স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে শুক্রবার বেলা এগারটার মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়। তবে দুপুরের দিকে নদীতে আবারও জোয়ারের পানি বৃদ্ধির কারনে বেলা দুইটার দিকে পার্শ্ববর্তী আরও সাতটি পয়েন্ট এর রিং বাঁধ নদীতে বিলীন হয়। যার ফলে আগের দিন প্লাবিত নেবুবুনিয়া ও গাবুরা গ্রামের পাশাপাশি খলিশাবুনিয়া ও লক্ষীখালী গ্রাম দু’টি নুতন করে প্লাবিত হয়েছে।
অপরদিকে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের দাতিনাখালী অংশের রিং বাঁধের উপর দিয়ে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশের পাশাপাশি পদ্মপুকুর ইউনিয়নের গড়কোমরপুর অংশের বাঁধ ভেঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রামের অর্ধেকটা প্লাবিত হয়।
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া বেড়িবাঁধ সংস্কার শেষ হতে না হতেই ফের বাঁধ ভেঙ্গে সব ভেসে গেছে। মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের মধ্যে ২০টি সম্পূর্ণ পানিতে তলিয়ে রয়েছে। পুরো ইউনিয়নে এখন নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হচ্ছে। এই মুহুর্ত্বে কোন মানুষ মরে গেলে তার দাফন করার মত জায়গাও নেই। খাবার পানি তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। পানির তোড়ে এলজিইডি’র পাকা সড়ক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদরসহ পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের সাথে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি বলেন, বরাদ্দ থাকার পরও যথা সময়ে কাজ না করায় এলকার বেড়িবাঁধ বারবার ভাঙ্গছে।
শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল জানান, তার গোটা ইউনিয়ন এখন পানিতে নিমজ্জিত। সাধারণ মানুষ বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ইউনিয়নের ২২টি গ্রাম সম্পূর্ণ পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ন ভেঙ্গে পড়েছে।
আশাশুনি উপজেলা চেয়ারম্যান এবিএম মোস্তাকিম জানান, বর্তমানে তার উপজেলার প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ভেসে গেছে হাজার হাজার বিঘা মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, তার ইউনিয়নের নেবুবুনিয়া, গাবুরা ও খলিসাখালী এখনও প্লাবিত। এছাড়া মল্লিকবাড়ি, গাজিবাড়ি ও মেইন ক্লোজারের পাশে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। তবে, হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে কোনো রকমে ৬টি পয়েন্টে রিং বাঁধ দিয়ে পানি বন্ধ করা সম্ভব হলেও নতুন করে ৭টি পয়েন্ট ভেঙ্গেছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশ কুমার সরকার কয়েকটি স্থানে রিংবাঁধ দিয়ে পানিবন্ধ করা হয়েছে বলে দাবি করেন।
তবে প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলা ও কুড়িকাউনিয়া এবং শ্রীউলা ইউনয়নের হাজরাখালী পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এতই গভীর হয়েছে যে সেখানে এখন বেড়িবাঁধ সংস্কার করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার বিকালে আশাশুনি উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, সাগরে নিন্মচাপের প্রভাবে ও টানা বর্ষণে নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার যে সমস্থ লোকজন অতি সংকটে রয়েছে তাদেরকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য ইউএনওদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই মুহুর্ত্বে আশাশুনি ও শ্যামনগরে ৪০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সার্বিক বিষয় ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, আশাশুনির দয়ারঘাট, হাজরাখালী ও প্রতাপনগরের বাঁধগুলি টেঁকসই করে নির্মান করার দায়িত্ব পেয়েছেন আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তবে শীত মৌসুমে ছাড়া বাঁধগুলি মেরামত সম্ভব নয় বিধায় সে পর্যন্ত আমাদের এসব রিং বাঁধগুলি টিকিয়ে রাখতে হবে। আমি বিভাগীয় কমিশনার, পানি উন্নয়ন বোর্ড, এাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রনালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে কথা বলেছি। তারা আমাদের সব ধরণের সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম