সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় পুরানো বাঁধ সংস্কারের পাশাপাশি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে এক হাজার ২০ কোটি টাকার ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং-১৫ পুনর্বাসন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। রাজধানীর শেরে বাংলা নগরস্থ এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এ প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সংযুক্ত প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভা শেষে প্রকল্পের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। এক হাজার ২০ কোটি টাকার ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং-১৫ পুনর্বাসন’ শীর্ষক প্রকল্পটি সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বিভাগ-১ এর আওতাধীন জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নে বাস্তবায়ন করা হবে। চলতি বছরেই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরু করবে।
প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার মানুষ। উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করছে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দ। এছাড়া আন্দোলন করছে ‘সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন’।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন সংগঠনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, বেড়িবাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে পানির চাপ ও বাতাসের গতিবেগ বাড়লেই খুলনা-সাতক্ষীরা উপকূলের অনেক এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এমনকি কয়েকটি এলাকার বাঁধ যেকোনো মুহূর্তে বিলীন হতে পারে। তাই সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো দ্রুত অনুমোদনের পাশাপাশি অনুমোদিত প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, জেলার সর্বশেষ প্রান্তে সুন্দরবন সংলগ্ন সমুদ্র উপকুলবর্তী হওয়ায় যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে শ্যামনগর উপজেলার মধ্যে গাবুরা ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। সবশেষ ঘুর্নিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পাউবো’র বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে তার ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম সম্পূর্ন প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইউনিয়নের ৬ হাজার পরিবারের প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ। বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হওয়ায় সব কিছু হারিয়ে অনেক মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়। প্রায় প্রতি বছরই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেকারণে বরাবরই আমাদের একটাই দাবি ছিল ‘ত্রাণ নয় আমরা চাই টেকসই বোড়িবাঁধ’। ঘুর্নিঝড় ইয়াসের পর পানিসম্পদ মন্ত্রীর গাবুরা সফরকালে আমরা জোরালো ভাবে টেকসই বোড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছিলাম। সে সময় তিনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন। সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং-১৫ পুনর্বাসন শীর্ষক একটি প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন হওয়ায় তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ও গাবুরা ইউনিয়নবাসির পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও পানি সম্পদ মন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
ইউপি চেয়ারম্যান আরো বলেন, এই প্রকল্পটি বাস্তাবয়ন হলে জেলার একমাত্র দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার জনগণ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। মানুষ তাদের জমিতে একাধিক বার ফসল ফলাতে পারবে। একই সাথে বাড়বে দেশের সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি চাষ। অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বি গাবুরার মানুষ। তিনি এক হাজার ২০ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি দুর্নীতির উর্দ্ধে থেকে সঠিকভাবে বাস্তাবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান।
সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবুল খায়ের প্রকল্পটি অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় পাউবো বিভাগ-১ এর আওতাধীন ১৫ নং পোল্ডারের গাবুরা ইউনিয়নে ২১ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ পুর্ননির্মাণ করা হবে। একই সাথে সিসি স্লোব দিয়ে ২৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ঢাল সংরক্ষন ও সিসি স্লোব ও জিও ব্যাগ দিয়ে ৮ কিলোমিটার নদ-নদীর তীর সংরক্ষন করা হবে। এছাড়া দ্রুত পানি প্রবেশ ও নিষ্কাশনের জন্য ৫টি রেগুলেটর ও ১১টি ইনলেট নির্মাণ করা হবে।
নির্বাহী প্রকৌশলী আরো বলেন, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার পর ঘুর্নিঝড় বা যে কোন ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগে মাটির নির্মাণ করা এই বেড়িবাঁধ আর ভাঙ্গবে না। এর ফলে ওই এলাকার মানুষ তাদের পতিত জমি কৃষি কাজের আওতায় নিয়ে আসতে পারবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত করতে না পারায় এক জমিতে দুই বার ধান চাষ করতে পারবে কৃষকরা। এতে করে ওই এলাকার মানুষ কৃষি কাজে আরো আগ্রহী হয়ে উঠবে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকুলের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্র ব্যাহত না হলে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হয়ে উঠবে।
প্রসঙ্গতঃ, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বিবেচনা করে ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং-১৫ পুনর্বাসন’ শীর্ষক প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়। গাবুরা ইউনিয়নে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ আওতাধীন এই ১৫ নং পোল্ডারটির তিন দিক খর¯্রােতা খোলপেটুয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদ দ্বারা বেষ্টিত। এই পোল্ডারের দক্ষিণ পাশে খোলপেটুয়া নদীর অপর পাশে সুন্দরবন। প্রকল্পটির আওতায় পুরানো বাঁধ বা অবকাঠামোর পুনরুজ্জীবিত করে কার্যকারিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ সুবিধা দেওয়া এবং লবণাক্ততা দূরীকরণ করা হবে। এছাড়া বিদ্যমান কৃষি বা মৎস্য উৎপাদন নির্বিঘ্নে করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটি ৩ হাজার ৪৪১ হেক্টর এলাকার কৃষি জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। যা এলাকার জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
খুলনা গেজেট/ টি আই