লোকসভা ও বিধানসভায় শূন্য আসন এবং পাঁচ শতাংশের কম ভোট নিয়ে বর্তমানে বঙ্গীয় সিপিআইএম-এর শোচনীয় অবস্থা। একেবারে অস্তিত্বের সংকট উপস্থিত। আমরা জানি, আই সি ইউ-এর সকল রোগীই মারা যায় না। কেউ কেউ মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরে আসে এবং শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে ওঠে। তেমনি এই বঙ্গে সাড়ে তিন দশক সরকার পরিচালনা করার কৃতিত্বের অধিকারী সিপিআইএমের পক্ষে গভীর সংকট কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তাছাড়া তারা নির্বাচনী লড়াইয়ে পর্যুদস্ত হলেও পথ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। সাংঘাতিকভাবে হেরেও একেবারে হারিয়ে যায়নি। নির্বাচনী ফলাফলের নিরিখে আপাতত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লেও বৃহত্তর রাজনৈতিক চর্চায় বামপন্থীদের বাতিল করা যায় না।এটা অবশ্যই তাদের জন্য একটা ইতিবাচক ব্যাপার।
২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দুর্ধর্ষ জয়ের পর থেকে পরপর পঞ্চায়েত-পৌরসভা, লোকসভা-বিধানসভা নির্বাচনে আসন সংখ্যা ও ভোটের হার হ্রাস পেতে পেতে এখনকার অবস্থায় পতিত হতে সিপিআইএম সময় নিয়েছে প্রায় পনের বছর। পতনে যখন এত সময় লেগেছে তখন সহসা উঠে দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। শূন্য থেকে সিংহাসন পুনর্দখলের প্রয়াস তাই সহজে সফল হতে পারে না। এক নম্বর থেকে দুই-তিন নম্বর হয়ে আজ যেমন তারা প্রতিযোগিতা থেকেই ছিটকে গেছে, তেমনি তৃতীয়ের পর দ্বিতীয় এবং তারপর প্রথম স্থান দখলের পরিকল্পনা করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই।
সিপিআইএমের কিন্তু একাধিক গর্ব করার মতো বিষয় রয়েছে। যেমন, বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনে কোনও বড় আর্থিক কেলেঙ্কারীর ঘটনা ঘটেনি। তাদের নেতা-মন্ত্রীদের তোলাবাজি-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রতারণা সংস্থাকে ‘প্রমোট’ করার প্রমাণ নেই। বামফ্রন্টের আমলে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হত। এখনকার মতো তখন প্রশাসক নিযুক্ত করে গণতন্ত্রের সংকোচন ঘটানো হয়নি। মধ্যশিক্ষায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের মতো প্রায় প্রতিটি বিভাগে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটা ধারাবাহিকতা ছিল। নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, পরীক্ষা গ্ৰহণ, ফল প্রকাশ ও নিয়োগ কার্য সম্পন্ন হত। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা স্বচ্ছতা থাকায় কখনও যোগ্য প্রার্থীদের বেআইনি ভাবে বঞ্চিত করার গুরুতর অভিযোগ ওঠেনি। এজন্য এখনকার মতো তখন আদালতে নিয়োগ সংক্রান্ত একটা মামলার রায় হতে না হতেই আরেকটা মামলা হত না। একইভাবে এখনকার মতো তখন টাকার বিনিময়ে ‘চাকরি বিক্রি’র চল ছিল না। বামফ্রন্ট সরকারের ভালো ব্যাপারগুলো জনগণকে স্মরণ করানোর দায়িত্ব বামপন্থী নেতাকর্মীদেরই পালন করতে হবে।
সিপিআইএমের একটি বড় ত্রুটি হল তারা তাদের ভালমন্দ সম্পর্কে দলের বাইরের লোকদের কোনও কথা শুনতে চায় না এবং যারা সহানুভূতিশীল হয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করেন তাদেরও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করা হয়। চিন্তা চেতনার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীল বলে দেগে দেওয়া হয়। দলের মধ্যে কেউ ‘অফিসিয়াল’ প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুললে অথবা ভিন্ন ভাবনা প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে বিচ্যুতি ঘটার অভিযোগ এনে তাকে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। এই ধরনের আচরণ এখন বন্ধ হওয়া দরকার। যেকোনো ব্যাপারে দলীয় মূল্যায়নের ভিত্তিতেই সিপিআইএম সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে। নেতৃত্বের জ্ঞানগম্যি সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করা হয়। এর মধ্যে কোনও দোষ নেই। কিন্তু চারপাশের ঘটনাবলীর বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করা না হলে মুশকিল। ঘটনা হল, নেতাকর্মীরা তাদের অজ্ঞতা, ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য অনেক সময় নিজেদের মধ্যে বেঠিক তথ্য-সংবাদ আদানপ্রদান করে থাকে। এজন্য দেখা যায়, দলীয় মূল্যায়নে দলের কোনও ভুল ধরা পড়ে না। এর ফলে ভুলও সংশোধন হয় না এবং একটার পর একটা ভুল হতেই থাকে। এজন্য অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের পাশাপাশি পার্টির বাইরের মানুষরা কী ভাবছে সেটাও একটু বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
সিপিআইএম তাদের পরাজয়ের প্রত্যক্ষ কারণগুলোকে সামনে না রেখে বরাবর অপ্রত্যক্ষ কারণসমূহের প্রতি প্রাধান্য প্রদান করে থাকে। এই ভাবের ঘরে চুরি চলতে থাকলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। তাদের বুঝতে হবে যে, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ তাত্ত্বিক আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে কিন্তু ভোটের বাজারে পাবলিকের কাছে এর কোনও মূল্য নেই। এজন্যই, বিজেপি কিংবা তৃণমূলকে বৃহৎ পুঁজির মালিকদের ‘প্রতিনিধি’ চিহ্নিত করার প্রয়াসকে সাধারণ মানুষ পাত্তা দেয় না। আগেকার দিনে কংগ্রেসকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে দেখানোর চেষ্টাকেও মানুষ গ্ৰহণ করেনি। বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের যে তত্ত্ব খাড়া করা হয় জনমানসে তারও কোনও প্রভাব পড়ে না। তাত্ত্বিক আলোচনায় মানুষের আগ্ৰহ নেই। সাধারণ মানুষ দলের মতাদর্শ নয় কাজকর্ম দেখে ভোট দেয়।
মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে সিপিআইএম প্রায়ই অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকে। এটা ঠিকই যে, সংবাদমাধ্যমে সিপিআইএম সেভাবে কোনদিনই প্রশংসিত হয় না। সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব নিয়েও কোনও সংশয় নেই। তবে সিপিআইএমের বদনাম সৃষ্টিতে মিডিয়া উঠে পড়ে লেগেছে, এমন মনে করাও সঙ্গত নয়। তাদের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক শক্তি হ্রাস হওয়ার জন্য মিডিয়াকে দায়ী করা যায় না। মিডিয়া জনমত গঠনে কিছুটা ভূমিকা পালন করলেও একটা নির্বাচনে কাউকে হারানো-জেতানোর ক্ষমতা তার নেই। তাছাড়া সংবাদমাধ্যম সব সময় একই সুরে কারও স্তুতি অথবা নিন্দাও করে না। তাদের মধ্যেও বিভাজন রয়েছে। সাধারণ মানুষ টিভি দেখে অথবা পেপার পড়ে ঠিক করে না তারা কাকে ভোট দেবে। ভোটাররা তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিভিন্ন দল-প্রার্থীর ভালমন্দের তুলনা করে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব কষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। মিডিয়ার প্রচারের আলো কাউকে ভোটে জিততে খুব একটা সাহায্য করে বলেও মনে হয় না। যেমন, টিভির অত্যন্ত পরিচিত মুখ সুবক্তা বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য কিংবা সিপিআইএমের তন্ময় ভট্টাচার্য হেরেছেন।
সিপিআইএম ধর্মনিরপেক্ষ দল এবং জাতপাতের রাজনীতি করে না। তাদের শ্রেণী-রাজনীতিতে মানুষের ধর্মীয়-সত্তার গুরুত্ব কম। ভালো কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজেদের ধর্ম-সম্প্রদায়ের স্বার্থ উপেক্ষা করতে পারে না। এজন্য সরকারের সকল জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে নজর থাকা দরকার। সেই সঙ্গে পার্টির নেতৃত্বেও সকল সম্প্রদায় ও বগের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব থাকা দরকার। সিপিআইএমে সেটার ঘাটতি রয়েছে। দলে আদিবাসী, তফসিলি ও সংখ্যালঘুদের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। এরা রাজ্যের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি কিন্তু ক্ষমতা ভোগ অথবা পদ পাওয়ার প্রশ্নে এক-তৃতীয়াংশের কম। সামাজিক ও আর্থিক দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে থাকা এই অংশের মানুষদের ক্ষমতায়নে সিপিআইএম আলাদা করে আগ্ৰহ দেখায়নি। বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে খুব বেশি রকম ভাবে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমান প্রার্থী এবং এস সি, এস টি সংরক্ষিত আসনে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রার্থী করে বাকি আসনগুলোতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রার্থী করাকে রীতিতে পরিণত করা হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান মন্ত্রীর সংখ্যা বরাবর কম থেকেছে এবং দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক দেওয়া হয়নি। পার্টি ও তার শাখা সংগঠনগুলোর বিভিন্ন স্তরের সম্পাদক-সভাপতির পদেও তাদের উপস্থিতি নগণ্য।এখন কিন্তু আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অনেক সংগঠন গড়ে উঠছে, সচেতনতা বাড়ছে। তারা বঞ্চনার বিরুদ্ধে ও অধিকার-অংশীদারির দাবিতে সরব হচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সিপিআইএমের প্রতি এই অংশের মানুষের সমর্থন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সুতরাং পুনর্জন্ম লাভ করতে হলে দল ও সংগঠনে সিপিআইএমকে সকল সম্প্রদায় ও বগের মানুষের প্রতিনিধিত্বের মধ্যে ভারসাম্য আনতেই হবে।
সিপিআইএম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হলেও সিদ্ধান্ত গ্ৰহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রিকতার ভূমিকাই বেশি। এজন্য প্রভাবশালী দু-চারজন নেতা যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন তার ভালমন্দ নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা ছাড়াই সেই প্রস্তাব ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ গৃহীত হয়ে যায়। ভিন্ন মত পোষণকে খুব একটা প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। দলে অবিলম্বে খোলামেলা আলোচনার সময় ও সুযোগ বৃদ্ধি করা দরকার। এখন অনেকেই সিপিআইএমকে ‘পক্ককেশীদের দল’ বলে থাকে। কেউ কেউ একটু কড়া করেই বলে, ওই দলে দেহত্যাগের আগে পদত্যাগের প্রথা নেই। দল যখন জিতেছে তখন এসব কথা আসেনি। কিন্তু আজ যখন পার্টির পরাজয়ের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে তখন তাকে গুরুত্ব দিয়েই দেখতে হবে। যৌথ নেতৃত্বের কথা বলে সকলেই যদি বিপর্যয়ের দায় এড়িয়ে যান তবে দল ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। দল বারবার হারলে কোচ-ক্যাপ্টেন পদত্যাগ করেন। নতুন নেতা দলকে জয়ের সারণিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এই মান্য রীতিটি সিপিআইএমে প্রবর্তন হওয়া দরকার।
খুলনা গেজেট/ টি আই