খুলনা, বাংলাদেশ | ২৯ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১২ মে, ২০২৪

Breaking News

  সারা দেশে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ; এসএসসিতে গড় পাসের হার ৮৩.০৪ শতাংশ, পাসের হারে শীর্ষে যশোর, সর্বনিম্ন সিলেট বোর্ড
  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতভর ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ৩

হাবড়া নদীর উপর কাঠের ব্রীজ তৈরি করে ইটভাটার মালামাল বহন

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ঘুষুড়ি গ্রামে তানজিন এন্টারপ্রাইজ (টিআরবি ভাটা) নামের ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ওই ভাটার ইট ও মালামাল বহনের সুবিধার্থে গত ১০ ফেব্রুয়ারি উজিরপুর শ্মশানঘাটের পাশে হাবড়া নদীর উপরে আড়াআড়িভাবে বানানো হয়েছে কাঠের ব্রীজ। ফলে ওই বাঁধের স্থানে পলিমাটি জমে জোয়ারভাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিবেশ ধ্বংসকারি টিআরবি ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, কালিগঞ্জের বাধাকুল মৌজার একাংশ ও ঘুষুড়ি মৌজার কিছু অংশ জুড়ে ২০০৭ সালের দিকে হাবড়া নদীর তীরে তানজিন এন্টারপ্রাইজ বা টিআরবি ইটভাটা তৈরি করেন সাতক্ষীরা সদরের চালতেতলা এলাকার মতিয়ার রহমান। ছয় বছর পর তিনি দাদনদাতাদের টাকা ফেরৎ বা ইট দিতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যান। একপর্যায়ে পাওনাদারদের টাকা ফেরৎ দেওয়ার জন্য তৎকালিন চম্পাফুল ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ ওই ভাটা নিয়ন্ত্রণে নেন। কয়েক মাস পর নলতার রহিম বক্স পাড়ের ছেলে হুদা ওই ভাটা পরিচালনার দায়িত্ব পান। এক বছর পর হুদাকে বিতাড়িত করে ভাটার মালিক বনে যান নলতা শরীফ এলাকার ফজলুর রহমান। তিনি ভাটায় থাকা ২০ লক্ষাধিক টাকার ইট বিক্রি করে নেন। সেই থেকে ফজলুর রহমান ওই ভাটা পরিচালনা করলেও ওই এলাকার জাকির হোসেন, আজগার আলী, সিরাজুল ইসলাম, ফেরদৌসসহ কয়েকজনকে ব্যবসায়িক অংশীদার বানিয়ে ওই ভাটা পরিচালনা করে আসছেন। ভাটার মাটিবহনকারি অবৈধ ডাম্পারের ধাক্কা খেয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাধাকুল চরের ৫ বছরের শিশু আব্দুস সালাম মারা গেছেন। মারাত্মক জখম হয়ে পঙ্গুত্বের পথে তারা বাবা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাটার মাটি ও ইট বহনের জন্য উজিরপুর শ্মশানঘাটের পাশে হাবড়া নদীর উপর দিয়ে একটি কাঠের ব্রীজ তৈরি করা হয়েছে। ব্রীজটির দক্ষিণ পাশে রয়েছে তানজিন এন্টারপ্রাইজ (টিআরবি) ইট ভাটা। একই ভাটায় স্টার ব্রিকস তৈরি করা হচ্ছে। ওই ভাটার ইট ও ইট প্রস্তুতের মাটি ব্রীজের উপর দিয়ে ট্রলিতে করে বহন করা হচ্ছে। ইট পোড়তে ভাটায় কখনো কয়লা (ঝিকঝাক) আবার কখনো কাঠ ও পুরাতন টায়ারের গুড়ো ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাটার চিমনি থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে আড়াইশত পরিবার বসবাস করে আসছে। চিমনি থেকে ১০ শয্যা বিশিষ্ঠ ঘুষুড়ি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের দূরত্ব ১৮৮৫ ফুট, কাজী আলাউদ্দিন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব ১৫২২ ফুট, চাঁদখালি সরকারি প্রাথমিক বির্দ্যালয়ের দূরত্ব ২২২০ ফুট, ঘুষুড়ি আল হেরা জামে মসজিদের দূরত্ব ৮০০ ফুট। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দূরত্ব ১১২৫ ফুট, উজিরপুর গ্রোথ সেন্টার ৯০০ ফুট। উজিরপুর বাজার থেকে ভাটার মাত্র দূরত্ব ৭০০ ফুট।

চম্পাফুল ইউপি’র ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুস সাত্তার মোড়ল জানান, হাবড়া নদীর কাটাখালি থেকে চালতেতলা পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার খনননের জন্য ১৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২১ সালের মার্চ মাসে খনন কাজ শেষ হয়। অথচ দু’সপ্তাহ আগে টিআরবি ভাটার ইট ও মালামাল বহনের জন্য হাবড়া নদীর উজিরপুর শ্মশানঘাটের পাশ দিয়ে আড়াআড়িভাবে দেবদারু গাছের খুঁটি ও তক্তা দিয়ে ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে খননকৃত নদীর ওই স্থানে পলিমাটি ভরাট হয়ে জোয়ার ভাটা বন্ধ হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে নদী খনননের প্রায় ১৫ কোটি টাকা পানিতে ভেসে যাবে। তিনি ওই ইটভাটা বন্ধের পাশাপাশি কাঠের ব্রীজটি দ্রুত অপসারণের দাবি জানান।

ঘুষুড়ি গ্রামের আব্দুস সামাদ, স্বাস্থ্য কর্মী সাহেব আলী ও আব্দুল্লাহ, চাঁদখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এবং কাজী আলীউদ্দিন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, লোকালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কেন্দ্র্রের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা তৈরির নিয়ম না থাকলেও তা উপেক্ষা করে নির্মাণ করা হয়েছে টিআরবি ভাটা। ভাটার ইট পোড়াতে কখনো কয়লা আবার কখনো কাঠ ও পুরাতন টায়ারের গুড়ো ব্যবহার করায় তা জনসাধারণ ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। চিমনির কালো ধোঁয়ায় বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জ্বর ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বাড়ছে। এ ছাড়া কৃষি জমির মাটি ইটভাটায় নিয়ে আসার সময় অবৈধ ডাম্পারের ধাক্কায় মানুষ, ভেড়া ও ছাগল মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া ভাটার মালামাল বহন করতে হাবড়া নদীর উপর কাঠের ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে। যাহা ওই নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হুমকি স্বরূপ। অবিলম্বে ওই ভাটা বন্ধ করার আহবান জানান তারা।

ঘুষুড়ি গ্রামের মোস্তফা গাজী জানান, পরিবেশ ধ্বংসকারি ও হাবড়া নদীর উপর কাঠের ব্রীজ নির্মাণ করে নদীর অস্তিত্ব বিনষ্টকারি টিআরবি ভাটা বন্ধ ও নদীর উপর কাঠের ব্রীজ তুলে দেওয়ার জন্য তিনি গত ১৮ ফেব্রæয়ারি প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছেন।

টিআরবি ভাটার ১০ শতাংশের ব্যবসায়িক অংশীদার জাকির হোসেন জানান, উজিরপুর ব্রীজটি সংস্কারের কাজ চলমান থাকায় জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে হাবড়া নদীর উপর যে কাঠের ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে তা যথেষ্ট সংকীর্ণ। ফলে নতুন ব্রীজ নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভাটার মালামাল ও জনসাধারণের সুবিধার্থে ওই কাঠের ব্রীজ ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

ভাটার অপর ব্যবসায়িক অংশীদার আজগার আলী জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও পাউবো’র প্রকৌশলীর অনুমতি সাপেক্ষে ভাটার মালামাল বহনের সুবিধার্থে কাঠের ব্রীজ বানানো হয়েছে। তবে ভাটায় কাঠ ও পুরাতন টায়ারের গুড়ো ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, পুরাতন ফর্মা থাকায় টিআরবি ইটের পাশাপাশি স্টার ইট তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েই নলতা শরীফের ফজলুর রহমান এ ভাটা পরিচালনা করে আসছেন।

টিআরবি ভাটার স্বত্বাধিকারী ফজলুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি পরে কথা বলবেন। তবে বিকাল তিনটার দিকে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস দীপু জানান, বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে তিনি দেখবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাতক্ষীরা শাখার উপপরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জানান, রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ঘটনাস্থলে লোক পাঠিয়ে বিস্তারিত জানার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সালাহ্উদ্দিন জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। তাই নদীর উপর এ ধরণের কাঠের ব্রীজ বানানোর জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। খোঁজ নিয়ে ঘটনার সত্যতা পেলে প্রশাসনকে দিয়ে নদীর জন্য হুমকি স্বরূপ ব্রীজ অপসারণ করা হবে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!