খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ১৯ মে, ২০২৪

Breaking News

  করোনায় একজনের মৃত্যু, শনাক্ত ১১
  তিন জেলায় বজ্রপাতে প্রাণ গেল ৭ জনের
  রাঙামাটিতে সশস্ত্র হামলায় ইউপিডিএফ সদস্যসহ নিহত ২

হাজারো জনতার উপস্থিতিতে খুলনায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ

কাজী মোতাহার রহমান

ষোল ডিসেম্বর একাত্তর। বিবিসি আকাশবাণী ইথারে ইথারে বিশ্ববাসীর কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র। আটষট্টি হাজার বর্গমাইল এলাকায় লাল সবুজের পতাকা উড়তে শুরু করেছে। পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেঃ আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী দলবলসহ রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছেন।

তখনও খুলনার শিরোমনি এবং গল্লামারীতে যুদ্ধ চলছে। খুলনা শহরের রাস্তাঘাট জনমানব শূন্য। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় খুলনাবাসী। খুলনার বিভিন্ন থানা মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা বটিয়াঘাটা থানার চক্রাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসে ক্যাম্প স্থাপন করেছেন। এখানকার মূল নেতৃত্বে নবম সেক্টরের শেষদিকের কমান্ডার মেজর জয়নাল আবেদীন খান। তার সাথে ছিলেন সাব সেক্টর কমান্ডার লেঃ এ এস এম শামসুল আরেফিন, নৌ কমান্ডো লেঃ গাজী রহমতুল্লাহ দাদু বীর প্রতীক, ক্যাপ্টেন শাহজাহান, নৌ কমান্ডে খলিলুর রহমান, বৃহত্তর খুলনা মুজিব বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু, মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার স ম বাবর আলী, শেখ আব্দুল কাইয়ুম প্রমুখ।

মেজর জয়নাল আবেদীন খানের নেতৃত্বে যোদ্ধারা ১৪ ডিসেম্বর রাতে গল্লামারীস্থ রেডিও পাকিস্তান খুলনা কেন্দ্র ও লায়ন্স স্কুলে পাকিস্তানী সেনা ছাউনীতে আঘাত করে। এ অভিযান চলে ১৭ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত। উল্লিখিত দুটি সেনা ছাউনী ছেড়ে পাকিস্তান বাহিনী সার্কিট হাউজে আসে। এ দুটি সেনা ছাউনীর বেশ কয়েকজন যোদ্ধা গল্লামারী ও বাগমারা এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আতœসমর্পণ করে। সাবেক সংসদ সদস্য স ম বাবর আলী ‘খুলনার আকাশে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা ও খুলনা বিজয়’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন ১৬ ডিসেম্বর রাতেই গল্লামারী যুদ্ধচলাকালীন সময়ে রেডিও’র মাধ্যমে খবর পাই ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা বেড়ে যায়। যুদ্ধের শেষ দিকের নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জয়নাল আবেদীন খান জীবদ্দশায় খুলনা শহর দখলের স্মৃতি চারণ করতে যেয়ে বলেন, গল্লামারী এলাকায় ১৭ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক সাড়ে ৭টা নাগাদ শত্রু পক্ষের গোলাগোলী স্তিমিত হয়ে যায়। বীর দর্পে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা সার্কিট হাউজে পৌছে যায়। এখানে তিনি ও গাজী রহমাতুল্লাহ দাদু বীর প্রতীক বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

অপরদিকে ১২ ডিসেম্বর রাতে মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল দলবীর সিং এর নেতৃত্বে ৮ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর ও ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলসহ বীরমুক্তিযোদ্ধারা শিরোমনিতে মরণপণ যুদ্ধে অংশ নেন। ১৩ ডিসেম্বর মেজর গণি ও মেজর মহেন্দ্র সিং এর নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী শিরোমনিতে ঢুকে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর আত্মœসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য মিত্র বাহিনীর লেঃ জেঃ জ্যাকব ঢাকায় যাওয়ার পথে হেলিকপ্টর থেকে যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন। যেহেতু ঢাকায় পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে সে কারণে শিরোমনির অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার নির্দেশনা দেন। ১৬ ডিসেম্বর রাতে মিত্র বাহিনী পুনরায় গোলাগুলি শুরু করলে পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণে রাজি হয়। ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবুল মঞ্জুর পাকিস্তানী সেনাকর্তাদের স্টার ও ব্যাচ খুলে দিতে বলেন। রাতে পাকিস্তানী বাহিনী টিএন্ডটি এর ওয়ারলেস ও স্টেট ব্যাংকের নগদ টাকা ধ্বংস করে দেয়। ১৭ ডিসেম্বর সকালে মিত্র বাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিং অপেক্ষা করতে থাকেন পাকবাহিনীর সেনা কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মœসমর্পণের জন্য এখানে আসবেন। এমন এক শুভক্ষণে মিত্র বাহিনীর নবম সেক্টরের স্টাফ অফিসার কর্ণেল দেশ পান্ডে এসে জেনারেল সিং কে জানান পাকিস্তানী বাহিনীর স্থানীয় অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ও তার সঙ্গীরা আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন। বিমান হামলার ভয়ে খুলনা সার্কিট হাউজ ছেড়ে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তার সদর দপ্তর নিউজ প্রিন্ট মিলে নিয়ে আসে। এখানে মিত্র বাহিনীর জেনারেল সিং সহ সেক্টর কমান্ডাররা উপস্থিত ছিলেন। সবাই একসাথে সার্কিট হাউজের উদ্যেশ্যে নিউজ প্রিন্ট মিল এলাকা ত্যাগ করেন। রাস্তার দু’পাশে হাজারো জনতা। অত্যাচারী পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করে। তাদের কন্ঠে গগন বিদারী শ্লোগান ‘জয় বাংলা’, স্বাধীনতা এনেছি শেখ মুজিবকে আনবো।

সতেরো ডিসেম্বর শুক্রবার বেলা দেড়টা নাগাদ খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে পাকিস্তান বাহিনীর স্থানীয় অধিনায়ক মিত্র বাহিনীর অধিনায়কের সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এ সময় নবম ইনফেন্ট্রি ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবুল মঞ্জুর, নবম সেক্টরের প্রথম দিকের কমান্ডার মেজর এমএ জলিল, একই সেক্টরের শেষদিকের কমান্ডার মেজর জয়নাল আবেদীন খান, পাকিস্তান বাহিনীর খুলনাস্থ সদর দপ্তরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মো. হায়াত খান, কর্ণেল খটক, কর্ণেল ফজলে হামিদ, মেজর ইশতিয়াক, মেজর বেলায়েত খান, মেজর একরাম, মেজর জাফর, মেজর বানড়ি, মেজর আব্বাসী, মেজর আলতাফ করিম, মেজর ইকবল বাহার, মেজর জুবলী, কমান্ডার গুলজারিন খান, লেঃ কোরবান ও লেঃ রফিক উপস্থিত ছিলেন। বিজয় বেশে বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে সার্কিট হাউজে উপস্থিত হন।

খুলনা গেজেট / এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!